সন্তোষ কুমার দত্ত : বাংলার দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি সপরিবারে দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যে দেবী দুর্গা সিংহবাহকী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তার ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষী ও নিচে গণেশ, বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিক। কলকাতায় সাবর্ন রায় চৌধুরী পরিবার ১৯১০ সালে এই সপরিবারে দুর্গা পূজা চালু করেন। তারা কার্তিকের রূপ দেন জমিদার পুত্রের, যা তৎপর্বে ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে। এ ছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষী, বামে উপরে কার্তিকের ও নিচে সরস্বতী ও কাঠামোর উপরে নন্দী ভূঙ্গীসহ বৃষবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়াকে দেখা যায়। কোলকাতায় কোন কোন বাড়িতে দুর্গোৎসব লক্ষী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথাও দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলো ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামোর যতই বৈচিত্র থাকুক বাংলার দুর্গোৎসব প্রায় সব জায়গায়ই দেবী দুর্গাকে সপরিবারে পূজা করা হয়।
দুর্গা : দুর্গ নামক একজন যিনি অসুরকে বধ করেন তিনিই দুর্গা নামে পরিচিত। আবার শ্রী শ্রী চৈতন্য অনুসারে এই দেবীই সব দেবতার একত্রে শক্তির প্রতিমূর্তি।
সিংহ- দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। দুর্গা পূজার সময় সিংহেরও পূজা করতে হয়। সিংহ মূলত রজোগুণের এক প্রচন্ড শক্তির উচ্ছাসের প্রতীক। এছাড়াও সিংহ মানুষের পশুত্ব বিজয়েরও প্রতীক।
মহিষাসুর : মহিষাসুর অসুর অর্থাৎ দেবদ্রোহী। তাই দেবী প্রতিমায় দেবীর পায়ের নিচে এই অসুর ‘সু’ এবং ‘কু’ এর মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্ধে অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির বিজয়ের প্রতীক। সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, ভয়-ভীতি, আপদ-বিপদ এ সবই আসুরিক শক্তির কাজ। যা দুর্গা এই অসুরকে বিনাশ করে।
তবে অসুর হলেও দুর্গোৎসবে মহিষাসুরেরও পূজা চলে আসছে। কালিকা পূরাণ অনুসারে মৃত্যুর কিছু সময় আগে নিজের মৃত্যুর অবস্থা স্বপ্নে দেখে ভয় পেয়ে মহিষাসুর ভদ্রকালীকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। ভদ্রকালী তাকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি না দিলেও তার ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে আর্শীবাদ করতে চান। মহিষাসুর দেবতাদের যজ্ঞভাগ বর চাইলে দেবী সেই বর দিতে রাজি হননি। কিন্তু মহিষাসুরকে এই আর্শীবাদ দেন যে যেখানেই দেবীর পূজা হবে সেখানেই তার পায়ের নিচে মহিষাসুরের জায়গা হবে।
গণেশ : গণেশ সিদ্ধির দেবতা। পূরাণ অনুসারে তিনি সর্বাওপূজ্য। গণেশের পূজা না করে অপর কোন দেবতার পূজা করা বিধান নাই। গণশক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ সেখানে সব প্রকার বাধা বিঘ্ন দূর হয়। দেবাসুর যুদ্ধে দেবতারা যতবারই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসুরদের সঙ্গে লড়াই করেছেন ততবারই তারা জয়ী হয়েছেন। গণেশের আর এক নাম বিঘ্ননাশ। অর্থাৎ বিশ্ননাশকারী। বিঘ্নে সন্তুষ্ট থাকলে মুক্তি নিশ্চিত বলে ধরা যায়। গণেশের বাহন মুষিক বা ইঁদুর।
লক্ষী : লক্ষী শ্রী, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও অভ্যুদয়ের প্রতীক। শুধু ধনৈশ্বর্যই নয়, লক্ষী চরিত্র ধনেরও প্রতীক। লক্ষীর বাহক পেঁচক বা পেঁচা। রূপে ও গুণে অতুলনীয় এই দেবীর এমন বিসৃত বাহন কেন, সে নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত। তবে হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও পেঁচাকে লক্ষীর বাহন হিসেবে দেখানো হয়নি। এটি একান্তই বাঙালি লোকবিশ্বাস। পেঁচা দিনে চোখে দেখে না তাই মনে করা হয় যারা দিনে চোখে দেখে না অর্থাৎ তত্ত¡ বিষয়ে অজ্ঞ- তারাই পেচকধর্মী। অনেকের ধারনা মানুষ যতকাল পেঁচকধর্মী থাকে ততদিনই সে ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষীর আরাধনা করে। তারা পেঁচাকে মুক্তিকামী সাধক বলে।
সরস্বতী : সরস্বতী জ্ঞানশক্তির প্রতীক। সরস্বতীর হাতে থাকে পুস্তক ও বীণা। সরস্বতীকে ধরা হয় বিদ্যা ও সুরের দেবী। সরস্বতীর বাহন হংস। হংস হিন্দুদের নিকট একটি পবিত্র প্রতীক।
কার্তিক : দেবতাদের সেনাপতি কার্তিকেয় বা কার্তিক সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক। যুদ্ধে শৌর্য-বীর্য প্রদিক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। তাই সাধক জীবনে এবং সাধারণ জীবনে কার্তিকেয়কে সন্তুষ্ট করতে পারলে শৌর্য-বীর্য লাভ করা যায় বলে সবার ধারনা।
কার্তিকেয়ের বাহন ময়ূর। সৌন্দর্য ও শৌর্য কার্তিকেয়র এই দুই বৈশিষ্ট্যই তার বাহন ময়ূরের মধ্যে দেখা যায়।
লেখক : শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩