অধ্যাপক অমূল্য চন্দ্র বৈদ্য : দীর্ঘ ৪৭ বছর পর তৃতীয়বার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছে। বেসরকারী শিক্ষকরা আশান্বিত হয়েছে। এবার তাদের ভাগ্যন্নয়ণ হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই মহান নেতার পথ অনুসরণ করে বর্তমান শিক্ষকবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করছেন এবং বিরাজমান সকল বৈষম্য সমাধানসহ শিক্ষা জাতীয়করণ করবেন। বেসরকারি শিক্ষকদের দুঃখ দূর্দশা দূর করবেন। এ দাবী বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের।
বেসরকারি শিক্ষকদের মূল দাবী শিক্ষা জাতীয়করণ। কিন্তু শিক্ষা জাতীয়করণের আন্দোলন বেগবান হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত দাবীগুলো আদায়ে শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব, শিক্ষক নেতাদের দালালি সুলভ মানসিকতা এবং দেশের সকল বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনগুলোর মূল নেতারা হচ্ছেন শহরীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষক।
মফস্বলের বেসরকারি শিক্ষকদের অভাব অনটনের কথা শিক্ষক নেতারা জানলেও এক্ষেত্রে তারা চুপটি মেরে বসে আছেন। মফস্বলের বেসরকারি শিক্ষকদের আয়ের উৎস হচ্ছে সরকারি অংশের বেতন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকরা বেতনের অন্যান্য সুযোগসুবিধা পান না বললেই চলে। শহর ও মফস্বল শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সমস্যা ও সুযোগগুলো এক নয়। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার মান ও ফলাফল প্রশংসার সাথে সরকার স্বীকার করলেও তাদের ন্যায্য দাবি পূরণে তেমন কোন ভূমিকা বা গুরুত্ব দিচ্ছে না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পিয়ন থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া মাত্র পাঁচশত টাকা। এ টাকায় যেখানে একটা ঝুপড়িঘরও ভাড়া পাওয়া যায় না সেখানে স্মর্তব্য শিক্ষক ও তার পরিবার পরিজনের মাথা গোজার ঠাঁই কোথায়?
বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষক ও কর্মচারীদের উৎসব ভাতা মূল বেতনের ২৫ শতাংশ শিক্ষক আর ৫০ শতাংশ কর্মচারীদের। সরকারি শিক্ষকগণ ৩টি উৎসব ভাতা ভোগ করলেও বেসরকারী শিক্ষকদের দেয়া ২টি। যা দিয়ে উৎসবপর্বে পরিবার পরিজনের বাড়তি চাহিদা মিটানো অসম্ভব। নিজেকে অকর্মণ্যভেবে অসহায়ত্ব আর মানসিক যন্ত্রনায় অতিক্রম করেন দিনের পর দিন। দেশের প্রতিষ্ঠিত ও পুরনো বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের ২৫-৩০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেও সহকারী অধ্যাপকের মর্যাদা দেয়া এবং উচ্চতর বেতন স্কেলের কোনোটাই পাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য এ কানুনটি তুলে দেয়ার দাবি করলেও এখনও তা বাতিল হচ্ছে না। কোনো অনুপাতের অজুহাত দিয়ে পদোন্নতি রোধ করা অযৌক্তিক, অমানবিক এবং অনিয়মতান্ত্রিক। এখানে বিষয়ভিত্তিক সমযোগ্যতা ও সমঅভিজ্ঞতাই একমাত্র পদোন্নতির মাপকাঠি হওয়া উচিত।
বেসরকারি স্কুল ও কলেজগুলোর শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারের হাতে চলে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিশিক্ষকের অতিপ্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ফলে স্কুল কলেজগুলোতে ব্যহত হচ্ছে পাঠদান। এখানে বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত শিক্ষকদের তালিকা থেকে মেধানুসারে প্রতিষ্ঠানের চাহিদানুসারে নিয়োগ দেয়া অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও নিয়োগ বাণিজ্য রোধে সফলতা আসতো।
শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না করা হলে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও নকলমুক্ত করা যাবে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু শিক্ষক কখনও আর্দশ শিক্ষক হতে পারে না। পরীক্ষায় নকল রোধ ও শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস দমন করার সাহস তাদের থাকার কথা নয়। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরেও শিক্ষা জাতীয়করণ হলো না, অতীতের কোনো সরকারই শিক্ষকদের দুর্দশা লাঘবে আন্তরিক ছিল না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৮ সালের মধ্যে শিক্ষা জাতীয়করণের ঘোষণা করেছিলেন কিন্তু নরঘাতক ও একাত্তরের হটে যাওয়া দালালেরা এ দেশটিকে পাকিস্তানের অনুরূপ একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে ও নির্মমভাবে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। তারা শিক্ষার প্রসার ও উন্নতি চায়নি। শিক্ষিত সচেতন নাগরিক সৃষ্টি হলে তাদের হাতে ক্ষমতা থাকবে না এটা ছিল তাদের বদ্ধমূল ধারণা। কিন্তু এ দেশের ছাত্র শিক্ষক জনতা তা অনুধাবন করে সাময়িক জন্তাদের হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। আমরা ভোটাধিকার পেয়েছি। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে শক্তি আওয়ামীলীগ দীর্ঘ ৪৭ বছরে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় বারের ক্ষমতায় এসেছে। আমরা মনে করি শিক্ষাক্ষেত্রে জগদ্বল পাথরের মতো চেপে বসা জঞ্চাল তিনি উপড়ে ফেলতে সমর্থ হবেন। তিনি ঘুণেধরা শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাবেন। শিক্ষা হবে এক ও অভিন্ন, অসা¯প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায় বেসরকারি শিক্ষকদের বয়স সীমা ৬৫ করা শিক্ষকদের অন্যতম দাবী। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠন ইতোমধ্যে শিক্ষা জাতীয়করণের লক্ষ্যে কালোব্যাস ধারণ, শিক্ষক ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল এবং অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছে। বেসরকারী শিক্ষকদের চাকুরিকালীন সময়ে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অবসরে গেলে এ দুর্ভোগ আরও চরমে পৌছে। অবসর ও কল্যাণের টাকা যথা সময়ে দেয়া হয় না বলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে।
সরকার ইতিমধ্যে ৩১৩টি কলেজ জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়াছে কিন্তু আমরা আশা করব ননক্যাডার ও ক্যাডার পদমর্যাদা শিক্ষকদের মধ্যে কোন প্রকার যেন বৈষম্য না থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের এসব দাবি বাস্তবায়িত করবেন। মানুষ গড়ার কারিগরেরা স্বতঃস্ফর্তভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান করবেন এবং দেশ গড়বেন। সন্ত্রাস ও পরীক্ষায় নকলরোধ হবে। দেশের মানুষ হবে শিক্ষিত। দিন বদলে যাবে। সচেতন ও আদর্শ নাগরিক হবে। নিয়ন্ত্রিত হবে জনসংখ্যা, কৃষিক্ষেত্রে আসবে বিপ্লব এবং সর্বোপরি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এ দেশ হবে সমৃদ্ধ। বাস্তবায়িত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীদের অনুরূপ বোনাস দেয়া প্রয়োজন।
লেখক : সদস্য, বাকবিশিশ কেন্দ্রিয় কমিটি।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩