অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন :
বাউল শিল্পীর কণ্যা লাবনী। বাবার হাত ধরে কৈশোরকালেই সঙ্গীত চর্চা শুরু। লেখাপড়ায়ও ভালো। টাঙ্গাইলের গোপালপুর সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অর্নাস পড়ে সে। বাবা আফজাল হোসেনের বয়স হওয়ায় পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে আর গান গাওয়া হয়না। এজন্য আয়রোজগারও বন্ধ। জমিজমা বলতে শুধু তিন শতাংশের ভিটে। বড় ভাই মামুন ট্রাক চালায়। বহু আগেই বিয়ে করে পৃথক সংসার। বাবামা ও বোনের খবর নেয়না। এমতাবস্থায় অনাহারি জনকজননীর মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে পার্টটাইম জব নেয় লাবনী। পাশাপাশি একটি ফোক গানের দলে ভিড়ে সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখে। মঞ্চে দল বেঁধে গান গেয়ে বাড়তি দু’চার পয়সা রোজগার করে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলেও তার গান প্রচার হয়েছে।
সম্প্রতি তিনচার মাস পর পর লাবনী গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল আসে বাবামার সাথে দেখা করতে। লাবনীর সঙ্গীত চর্চা নিয়ে গ্রামের মোল্লা শ্রেণীর বরাবরই বিরোধীতা ছিল। ওদের সাথে যোগ দেন ক’জন নিকটাত্মীয়। লাবনীর বাবামাকে একাধিবার সতর্ক করা হয়, তাদের অবাধ্যে লাবনী যেন সঙ্গীতের ধারের কাছেও না যায়। আর কথা না শুনলে তাদেরকে সমাজচ্যূত করা হবে।
গত ঈদে লাবনী এক সহশিল্পীকে নিয়ে বাড়িতে আসেন। ওই শিল্পীর সাথে হালকা ঘনিষ্ঠতা ও হাসিঠাট্রা করতে দেখে গ্রামের রক্ষণশীলরা চটে যায়। তারা লাবনীকে নিয়ে নানা কুকথা বলে বেড়াতে থাকে। এর জের ধরে গত শনিবার দুপুরে বড় ভাই মামুন লাবনীকে নাজেহাল করে। গান ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। গান করলে গলা কেটে হত্যার হুমকি দেয়।
গত রবিবার লাবনী নিজের জীবনের নিরাপত্তা এবং গান গাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে গোপালপুর থানায় জিডি করেন। পুলিশ ওই দিন রাতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বড় ভাই মামুনকে থানায় নিয়ে আসে। পরে লাবনীকে গাইতে বাধা দেয়া হবেনা মর্মে মুচলেকা দিয়ে মামুন ছাড়া পায়। এ সুযোগে গ্রামের একটি মৌলবাদী মহল গত সোমবার রাতে লাবনীদের বাড়িতে চড়াও হয়ে তার বাবামা এবং তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্জিত করে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের ফতোয়াবাজরা ফরিদুল ইসলামের বাড়িতে এক সালিশী বৈঠক ডাকে। সেখানে লাবনী ও তার বাবামাকে ডাকা হয়। গান গাওয়ার জন্য লাবনীকে চরিত্রহীন আখ্যা দেয়া হয়। পরে একশ টাকার সাদা স্ট্যাম্পে লাবনী ও তার বাবামার টিপসই ও দস্তখত নেয়া হয়। মৌখিক ভাবে তিন শর্তে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তা হলো লাবনী আর কোনো দিন সঙ্গীত চর্চা করতে পারবেনা। তাকে পর্দা মেনে চলাচল করতে হবে। ঢাকায় নয় বাড়িইে তাকে অবস্থান করতে হবে।
লাবনী অভিযোগ করেন, ওই বৈঠকে সমাজপতিরা সঙ্গীত চর্চার অভিযোগে সবার সামনে তাকে চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে ভৎসর্ণা করে। লাবনী বলেন, গান তার প্রাণ। ফতোয়াবাজরা মিলে আমার শিল্পী সত্বাকে হত্যা করতে চায়। গান গাইতে না পারলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে?
এ ব্যাপারে লাবনীর বাবা আফজাল হোসেন অভিযোগ করেন, মেয়েটাকে গান গাওয়া বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে মুচলেকা নেয়া হয়েছে। আমার চালচুলো নেই। সারা জীবন গান গেয়ে সময় পার করেছি। ফতোয়াবাজদের মারপিট আর মুচলেকার ভয়ে বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে সারা জীবনের জন্য সঙ্গীত চর্চা বন্ধ রাখতে বলেছি। তাকে বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে মানা করা হয়েছে। এভাবে গানের পাখিকে ওরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। মেয়েটা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কখন আত্মহত্যা করে বসে সেই ভয়ে তটস্থ রয়েছি।
এ ব্যাপারে ওই গ্রামের সমাজপতি এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আলহাজ ফরিদুল ইসলাম বলেন, গ্রামের লোকেরা চাননা কোনো মেয়ে মানুষ বাইরে গিয়ে গান করুক। তারা মনে করেন মেয়েরা গান গাইলে তাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। লাবনী ও তার বাবামার নিকট থেকে মুচলেকা নেয়ার সত্যতা স্বীকার করে তিনি জানান, লাবনী যদি পর্দানশীন হয়ে এবং চরিত্র ঠিক রেখে গান গায় তবে গ্রামবাসি সম্মতি দেবে।
এ ব্যাপারে ঝাওয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম জানান, ওই গ্রামের মানুষ চায়না মেয়েরা ঘরে বা বাইরে গান করুক। তারা খুবই রক্ষণশীল। লাবনী যাতে আরো নির্যাতিত বা কোনঠাসা না হয় সে জন্য গ্রামবাসিকে হুশিয়ার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলরুবা শারমীন জানান, এ ডিজিটাল যুগে এমন অভিযোগ বা আচরণ সত্যিই বিস্ময়কর। লাবনীকে আজ বিকেলে অফিসে ডেকে আনা হয়েছিল। তাকে নির্ভয়ে সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য বলা হয়েছে। কেউ বাধা দিলে বা ফতোয়া দেয়ার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩