:: অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন :: পলাশীর যড়যন্ত্রকারি ও নবাব সিরাজ হত্যাকারিরা কেউই শাস্তি থেকে রেহাই পাননি। নিয়তি তাদের প্রত্যেকের কপালে যেমন কলঙ্কের কালিমা লেপন করেছে- তেমনি তাদের কারোর স্বাভাবিক প্রয়াণ ঘটেনি। মীরজাফর ও মীরনের পর এবার দেখা যাক অন্যাণ্য বিশ্বাসঘাতক ও খলনায়কদের ভাগ্যে কী কী ঘটেছিল।
সিরাজ হত্যায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন মোহাম্মদী বেগ। আগের পর্বে মোহাম্মদী বেগ সম্পর্কে মোটামোটি বিবরণ দেয়া হয়েছিল। মীরণের নির্দেশে নবাব সিরাজকে হত্যার পর মোহাম্মদী বেগ প্রচুর ইনাম পান। মীরজাফর পরিবারের ঘনিষ্ঠ অনুচর হিসাবে পরিচিতি ঘটে। মুর্শিদাবাদ শহরের দক্ষিন কোনে এক বিশাল বাড়ি বানায় এ ঘাতক। অর্থবিত্তের রোশনাই তাকে বিলাসী করে তোলে। কালক্রমে এ খুনি দাম্বিক ও অহঙ্কারি হয়ে উঠে। কিন্তু বেশি দিন এ অবস্থা স্থায়ী থাকেনি। সৃষ্টিকর্তা এ কুখ্যাত ঘাতকের উপর লানত ফেলেন। প্রচুর ভোগবিলাসের মধ্যে বসবাস সত্বেও নতুন রোগ দেখা দেয়। তাহলো নিদ্রাহীনতা। প্রথম দিকে রাতে ঘুমাতে গিয়ে দুঃস্বপ্নে নিদ্রাভঙ্গ হতো। নামিদামী রাজকীয় কবিরাজের চিকিৎসা চলে। কিন্তু নিদ্রাহীনতা আর দূর হচ্ছিলনা। দীর্ঘ দিনের নিশি যাপনের ফলে শরীর মন দুটোই ভেঙ্গে পড়ে। তিনি নাকি প্রিয়জনদের বলতেন, ‘দুচোখ মুদলেই রক্তাত্ব নবাব সিরাজ সামনে এসে হাজির হন।’ বলতে থাকেন, ‘মোহাম্মদী বেগ এতো আপন হয়ে আমাকে এতো কষ্ট দিয়ে হত্যা করলি?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
গ্রন্থাগার রওশন অরণ্যের ভাষায়- “সিরাজ স্বপ্নে মোহাম্মদী বেগের সাথে দেখা দিতেন কিনা সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে মোহাম্মদী বেগ প্রভূর সঙ্গে যে বেঈমানী করেন তা তাকে অনুশোচনার অনলে দগ্ধীভূত করেছিল। বিবেকের যন্ত্রনায় অস্বস্ততিতে ভুগছিল। এটি হয়তো মানসিক রোগে পরিণত হয়।” যাই হোক, দীর্ঘ দিন অনিদ্রার ফলে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে উন্মাদ হয়ে পড়েন। স্বজনরা বাড়িতে শিকল পড়িয়ে অন্তরীন করে রাখতেন। কখনো সতর্ক পাহারা এড়িয়ে বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতো। আর বিড় বিড় করে অনবরত বকতো। শেষ পর্যন্ত ১৭৬০ বা ৬২ সালের কোনো এক সময়ে মোহাম্মদী বেগ বিকারগ্রস্ত হয়ে মারা যান। মুর্শিদাবাদ শহরে পরবর্তীতে তার উত্তরসূরিরা একটি মসজিদ নির্মাণ করে। এটি এখনো দেখতে পাওয়া যায়। বেগের উত্তরসূরি দাবিদার কেউ কেউ এখনো মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে বসবাস করেন।
পলাশীর অপর বিশ্বাস ঘাতক উমিচাদ ছিলেন শঠ। আর এ শঠের সাথে শঠামি করেন লর্ড ক্লাইভ আর মীরজাফর। পলাশী যুদ্ধের আগে লর্ড ক্লাইভ, মীরজাফর, উমিচাঁদ আর জগৎশেঠরা নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পাঁকাপাকি করেন একটি লিখিত দলিলে সই করে। সেই দলিলে মীরজাফর বাংলার মসনদে বসার বিনিময়ে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানিকে এক কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। (লিখিত ছাড়া ছিল ৫২ লক্ষ টাকা। যেটি লর্ডক্লাইভ পরে আত্মসাৎ করেন) সমগ্র দলিলটি সম্পাদনে মূল ভূমিকা পালন করেন উঁমিচাদ। তিনি দাবি করেন তাকে এর ৫ পারসেন্ট দিতে হবে। অন্যথায় গোপন চুক্তির বিষয়টি নবাব সিরাজের কাছে ফাঁস করে দেবেন।
উঁমিচাদের এ হুমকিতে ইংরেজ ও মীরজাফর গং ভড়কে যান। এমতাবস্থায় লর্ড ক্লাইভ প্রতারক উমিচাঁদকে ঠকানোর মানসে গোপনে সাদা ও লাল কাগজে দুটি পৃথক দলিল সম্পাদন করেন। লাল কাগজের দলিল ছিল জাল। আর সাদা কাগজেরটি ছিল আসল। লাল কাগজের দলিলে উঁমিচাদকে ২০ লক্ষ টাকা দেয়ার চুক্তি হলো। এ দলিলের অধিকাংশ স্বাক্ষর ছিল। আর তা করেন ক্লাইভ নিজে। অতঃপর উঁমিচাদ ভাবলেন নবাব সিরাজ ক্ষমতাচ্যূত হলে চুক্তি মোতাবেক ২০ লক্ষ টাকা পাবেন। পলাশী যুদ্ধে উঁমিচাদ নবাবের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। নবাব সিরাজ ক্ষমতাচ্যূত ও নিহতের পর মীরজাফর ক্ষমতায় বসেন। আর তখন উঁমিচাদ দলিল মোতাবেক ২০ লক্ষা টাকা দাবি করেন। ক্লাইভ সাদা কাগজের দলিল দেখিয়ে জানান তাকে টাকা দেয়ার কোনো শর্ত নেই। এ “শঠে শ্যাঠাং” এ উঁমিচাদ মানসিকভাবে আহত হন। ষড়যন্ত্রের ভাগ বাটোয়ারার টাকা না পাওয়ায় নানা ভাবান্তর ঘটলো। মীরজাফর ব্যক্তিগতভাবে উঁমিচাদকে অপছন্দ করতেন। এ জন্য ক্ষমতায় বসেই উঁমিচাদের সহায়সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন। এমতাবস্থায় উঁমিচাদ ২০ লক্ষ টাকা এবং ধনসম্পদ হারানোর শোকে উন্মাদ হয়ে পড়েন। সারা দিন ভাগীরথি নদীর তীরে বসে আবোলতাবোল বকতেন। ১৭৫৮ সালের কোনো এক সময়ে নদীতীরে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
পলাশী যুদ্ধের আরেক শঠ লর্ড ক্লাইভ প্রাকৃতিকভাবেই কঠিন সাজা পেয়েছিলেন। বাংলায় ইস্ট কোম্পানির রাজত্ব স্থাপনের একক কৃতিত্বের দরুন বৃটেনে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়া হয়। ক্লাইভ ১৭২৫ সালে বৃটেনে জন্মগ্রহন করেন। বেকার ক্লাইভ প্রথম জীবনে অর্থকষ্টে দিন কাটান। এরপর ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানীর চাকরি নেন। পরে যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করে কোম্পানির সেনাবিভাগে পদোন্নতি পান। ঐতিহাসিক জর্জ হ্যাঁসলের মতে- “ক্লাইভ যুদ্ধের চেয়ে ষড়যন্ত্র আর প্রতারণায় দক্ষ ছিলেন। তিনি শুধু ষড়যন্ত্র আর শঠামি দিয়েই ভারতে ইংরেজ প্রভূত্য স্থাপন করতে সক্ষম হন।” বিলেতে ফিরে তিনি অর্থবিত্তে ফুঁলে ফেপে উঠেন। পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরজাফরের নিকট থেকে চুক্তি মোতাবেক যে নগদ এক কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা পান তার অতিরিক্ত অলিখিতভাবে আরো ৫২ লক্ষ টাকা বাগিয়ে নেন। এ অলিখিত টাকা কোম্পানি ফান্ডে জমা না দিয়ে ক্লাইভ আত্মসাৎ করেন।
কাঁচা টাকা পেয়ে ক্লাইভ বৃটেনের অভিজাত মহলের সাথে টেক্কা দিয়ে চলতে থাকেন। ইতিমধ্যে কোম্পানির অনেক কর্মচারি দেশে ফিওে ছলচাতুরির মাধ্যমে বাংলা থেকে ক্লাইভের বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য ফাঁস করেন। বিষয়টি বৃটিশ আইনসভার উত্থাপিত হয়। হাউজে তাকে চোর বলে ভৎসর্ণা করা হয়। এ নিন্দাবাদ তার অহংকারে আঘাত করে। চারদিকের লোকনিন্দায় তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর বার্কলী ক্সয়ারের বাসায় পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। রবস স্পেয়ার নামক স্থানে তার সমাধি রয়েছে।
ঘৃণিত ষড়যন্ত্রকারি জগৎশেঠ রক্তমাংশে বজ্জাত স্বভাবের ছিলেন। মীরজাফরের পর মীরকাশিম বাংলার মসনদে আরোহন করলে জগতশেঠ তার বিরুদ্ধাচারণ করেন। ইংরেজদের সাথে নানা কারণে মীর কাশিমের বিরোধ তৈরি হয়। মীরকাশিমের সাথে ইংরেজদের কয়েক দফা যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে জগত শেঠ মীরকাশিমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ১৭৬৪ সালে বক্সার যুদ্ধে ক্ষমতা হারানোর আগে মীরকাশিম বেঈমান জগতশেঠকে প্রাসাদের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে ভাগীরথি নদীতে ফেলে হত্যা করেন।
শেষ রইলো মীর কাশিম। তিনি ছিলেন মীরজাফরের জামাতা। পলাশী যুদ্ধে তিনি নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইতিহাসে তিনি ঘৃণিত হয়ে রয়েছেন। নবাব সিরাজকে বন্দী করার সময় মীরকাশিম বেগম লুৎফার সাথে খুব হীন আচরণ করেন। লুৎফার গায়ের সকল গহনাপত্র তিনি খুলে নেন। তিনি নবাব সিরাজ ও লুৎফাকে খুব অপমানজনকভাবে বন্দী করে হেনস্তা করেন। ১৭৬৪ সালে বক্সার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীরকাশিম ফেরারী জীবনযাপন শুরু করেন। ইংরেজদের রোষানল থেকে বাঁচার জন্য তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লীতে পালিয়ে যান।
তখন দিল্লীতে মুঘলরা ছিল ক্ষমতায়। সেখানে কপর্দক শুণ্য অবস্থায় দীনহীন কঠিন জীবন শুরু হয়। এক বস্তিতে ঠাঁই হয়। ধারকর্জ আর মানুষের করুণা ভিক্ষা করে ক্ষুন্ন বৃত্তি করতে হয় তাকে। এ দুর্দিনে পরিবারের কেউই তার সাথে ছিলনা। ১৭৭৭ সালের কোনো এক সময়ে দিল্লীর এক বস্তিতে তিনি পরলোকগমণ করেন। অজ্ঞাতকূলশীল হিসাবে তাকে কোথাও দাফন করা হয়। তার সমাধি আজো চিহ্ণিত করা সম্ভব হয়নি। এভাবে পলাশীর ষড়যন্ত্রকারিরা শুধু ইতিহাসেই ঘৃণিত হননি- কালক্রমে নানা মাত্রায় শাস্তি পেয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। আর নবাব সিরাজ? তিনি এখনো বাঙ্গালী মানসে মহানায়ক হয়ে বেঁচে রয়েছেন।
ফটো ক্যাপশন : মুর্শিদাবাদ নগরীতে অবস্থিত অপূর্ব স্থাপত্য হাজার দুয়ারী প্রাসাদ। তৈলচিত্রে লর্ড ক্লাইভ এবং প্রতিবেদক অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন।
প্রতিবেদক : দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এর এডিটর এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩