:: মোকাম্মেল হোসেন ::
বাসের সিটে বসে আছি। চুপচাপ। সামনের সিটে বসা এক তরুণী মোবাইল ফোনে কথা বলছে। বিরামহীন। কথা চলার এক পর্যায়ে তাকে বলতে শুনলাম-
-বিশ্বাস কর, অনেস্টলি বলতেছি- ওর সঙ্গে এখন আমার ব্রেক-আপ চলছে...
আজকাল ব্রেক-আপ শব্দটা খুব শোনা যায়। অভিধানে ব্রেক-আপ শব্দের বাংলা করা হয়েছে অবসান, ছুটি, সাময়িক বিরতি ইত্যাদি। তরুণ-তরুণীরা যখন কারও সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের সর্বশেষ অবস্থা বোঝাতে এ শব্দটি উচ্চারণ করে- তখন বুঝতে হবে, তার হৃদয়রাজ্যের বাগানটির পরিচর্যা করত যে মালি, তাকে আপাতত ছুটি দেয়া হয়েছে। এটাকে বিরহ বলা যাবে কি? ভালোবাসার আগুন বুকে নিয়ে বিরহ পথ চলে। পথের শেষ হবে কখন- সেই অপেক্ষায় উন্মুখ থাকে। তরুণীর কথায় মনে হচ্ছে না- ব্রেক-আপ জিনিসটা যন্ত্রণাদায়ক কিছু।
বিরহ কতটা যন্ত্রণাদায়ক- যারা এর সংস্পর্শে এসেছেন, তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে লোককাহিনী, গল্প-কবিতা-উপন্যাসে, নাটক-সিনেমা-গানে বিরহকাতর নর-নারীর যন্ত্রণার যে রূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে- যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তা থেকে আমরা একটা ধারণা পাই। প্রচলিত কাহিনী এ রকম- মক্তবে পড়ার সময় ধনীর দুলালী লাইলির প্রণয়াসক্ত হয় এক ছাত্র। মাশুকের প্রতি আকর্ষণ তাকে এতটাই বিভোর করে- লোকজন প্রকৃত নাম বাদ দিয়ে তাকে ‘মজনুন’ নামে ডাকতে থাকে, যার অর্থ হচ্ছে প্রেমিক, পাগল ইত্যাদি। মজনুন থেকেই মজনু নামের উৎপত্তি, যাকে ছাড়া প্রেমের কাব্য অসম্পূর্ণ। পরবর্তী সময়ে মজনুর প্রেমের মূল্য না দিয়ে লাইলির পরিবার লাইলিকে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে দিলে বিরহ-যাতনায় কাতর মজনু লোকালয় ছেড়ে নির্জনে চলে যান। এ সময় মরুভূমির বুকে পশুপাখির সঙ্গে তার বিচরণ করার কথা লোকমুখে প্রচারিত হতে থাকে।
প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ-বেদনাই কি বিরহের একমাত্র সংজ্ঞা? নজরুল প্রেমিক হৃদয়ের আকুতি নিয়ে নার্গিস-বিচ্ছেদগাথা সাহিত্যের ভাষায় প্রকাশ করেছেন। আবার প্রিয় সন্তানের অকাল-মৃত্যুজনিত বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা বাবার হৃদয় দিয়ে গানে রূপ দিয়েছেন। দুটি বিচ্ছেদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও উৎস এক- ভালোবাসা। এই ভালোবাসা জিনিসটা আসলে কী? তার বাড়ি কোথায়?
আল্লাহপাক হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির প্রাক্কালে ফেরেশতাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হলে মানবের প্রতি ভালোবাসার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ সৃষ্টির মূলে রয়েছে স্রষ্টার প্রেম। এই প্রেম তিনি তার সৃষ্ট সব জীবের মধ্যেই অনুরণিত করেছেন। আল্লাহপাক তার সৃষ্ট জীবের ক্বলবে প্রেম-ভালোবাসার যে বীজ বপন করে দিয়েছেন, সেটাই প্রতিনিয়ত নানারূপে বিকশিত হয়ে হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার কাব্য তৈরি করছে।
জগতের জীবকূল একেক আঙ্গিকে ‘প্রেমের’ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও খুব অল্পসংখ্যক প্রাণীকেই ভালোবাসার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, বিবাহের কিছুকাল পরে স্বামীর মৃত্যুর পর মুসলিম রীতি অনুযায়ী ‘ইদ্দত’ পালন শেষে লাইলি মজনুকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হলেন। মজনুর খোঁজে লাইলি নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর শেষে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। লাইলি তার হাবেলির কাছাকাছি এক মিষ্টির দোকানদারের সঙ্গে চুক্তি করলেন। চুক্তি অনুযায়ী রাজ্যে মজনু নামে যত লোক আছে, সবাই এ দোকানে বিনা পয়সায় খেতে পারবে। এ কথা জানাজানির পর দোকানের সামনে লম্বা লাইন পড়ে গেল। সবাই মজনু। লাইলি দেখলেন, অবস্থা বেতাল। তার দরকার একজন মজনু। এত মজনু দিয়ে তিনি কী করবেন! এভাবে চলতে থাকলে স্বামীর রেখে যাওয়া ধনভাণ্ডার অল্পদিনেই নিঃশেষ হবে- এটা বুঝতে পেরে তিনি একটা বুদ্ধি বের করলেন। দোকানদারের কাছে একটা খঞ্জর সরবরাহ করে বললেন-
-এখন থেকে কেউ নিজেরে মজনু দাবি কইরা মিষ্টি খাইতে চাইলে একটা শর্ত মানতে হবে।
- কী শর্ত?
শর্তটা হল, চাক্কু দিয়ে নিজের একটা চোখ উৎপাটন করে মজনুকে প্রথমে ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে হবে। তারপর সে যত খুশি মিষ্টি খেতে পারবে। শর্ত শুনে সব মজনু হাওয়া। এর অনেকদিন পর রুগ্ন, জীর্ণ-শীর্ণ চেহারার এক যুবক মিষ্টির দোকানের সামনে এসে পানি খেতে চাইল। দোকানদার কৌতূহলবশত তার নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলল-
-নাম মনে নাই।
দোকানদার আশ্চর্য হয়ে বলল-
-বাপ-মা যে নাম রাখছে, সেইটা মনে নাই?
- না। অনেক আগে থেইকা লোকজনের মুখে ‘মজনুন-মজনুন’ ডাক শুনতে শুনতে আমি আমার আসল নাম ভুইল্যা গেছি।
-মজনুন! তার মানে মজনু?
- জ্বি।
দোকানদার অত্যাশ্চর্য হলেন। বললেন-
-যাক, অনেকদিন পরে এক মজনুর দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু তোমাকে তো পানি দিতে পারব না।
- আমার অপরাধ?
-তোমার কোনো অপরাধ নেই যুবক। লাইলির সঙ্গে আমার চুক্তি অনুযায়ী মজনু নামের কেউ এই দোকানের কিছু খাইতে চাইলে তাকে নিজের হাতে তার একটা চোখ উপড়ে ফেলে প্রমাণ করতে হবে- সে সত্যিই মজনু।
- এই কথা লাইলি বলেছে!
- শুধু বলে নাই, চাক্কুও সাপ্লাই দিছে। দোকানদার মজনুকে চকচকে খঞ্জর দেখাল।
মজনু খঞ্জর হাতে নিলেন। তারপর একে একে নিজের দুটি চোখই উপড়ে ফেলে দোকানদারের উদ্দেশে বললেন-
-লাইলি একটা চোখ চাইছিল! আমি দুইটাই দিয়া দিলাম।
যারা বলেন, ভালোবাসার জন্য নারী যতটা আত্মত্যাগ করে, পুরুষ ততটা করে না- তারা মজনুর উৎপাটিত চোখ দুটির কথা ভাবুন। সেখান থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তধারার কথা কল্পনা করুন। দেখুন- ভালোবাসার জন্য পুরুষের আত্মত্যাগ দেখুন।
ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে মজনু চোখ উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু জীবন উৎসর্গের কথা তো ভাবেননি! জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা হয় না তাহলে কে? একদিন টেলিভিশনের পর্দায় তার দেখা পেলাম। সে কোনো মানব-মানবী নয়; স্রেফ একটা পশু। নাম ওয়াইল্ডবিস্ট। তৃণভোজী ওয়াইল্ডবিস্টরা যাযাবর প্রকৃতির প্রাণী। খাবারের সন্ধানে তারা স্থানান্তর ঘটায়। স্থানান্তরের সবচেয়ে বিপদসংকুল পথ হচ্ছে, আফ্রিকার ‘মরা’ নদী। নদীটি কুমির দ্বারা পরিপূর্ণ। স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে এ নদীর পানিতে যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে অজস্র ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রা, তখন জীবন ও মৃত্যু এত কাছাকাছি অবস্থান করে- এ দৃশ্য যে দেখেনি, তার পক্ষে তা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বাঁচা-মরার লড়াই চলাকালে এক ওয়াইল্ডবিস্ট মা তার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিল। মাঝ নদীতে কুমিরের তাড়া খেয়ে মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল তার শাবক এবং দিকভ্রষ্ট হয়ে আগের জায়গায় ফিরে গেল। মৃত্যুর ঘ্রাণ নিতে নিতে নদী পার হওয়ার পর মা ওয়াইল্ডবিস্ট তার শাবককে কোথাও দেখতে পেল না। মা বুঝতে পারল- শাবক ওপারে রয়ে গেছে। সে আবার দাঁড়াল মৃত্যুর সামনে। নদীতে হাজার হাজার পশু যখন একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখনকার পরিস্থিতি- আর এখনকার পরিস্থিতি কোনোমতেই একরকম নয়। একটা মাত্র ওয়াইল্ডবিস্ট কুমিরের জালে গড়িয়ে পড়লে, তার কুমিরের পেটে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯ ভাগ। বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র শূন্য দশমিক এক ভাগ। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও বাৎসল্য এক মাকে শূন্য দশমিক এক ভাগের দিকেই টেনে নিয়ে গেল। মা ঝাঁপ দিল নদীর জলে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে টেলিভিশনের সামনে বসে আছি। ও আল্লাহ! মা ওয়াইল্ডবিস্টের বেঁচে যাওয়া একটা অলৌকিক ঘটনা। অবশ্যই অলৌকিক ঘটনা।
একটা পশু যদি সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এভাবে- তাহলে মানুষের ক্ষেত্রে তার রূপ কেমন হবে? গল্পটা আমার মায়ের মুখে শোনা। এক ছেলে তার বৃদ্ধা মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে, এমন সময় আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেল। বৃদ্ধা মা উচ্চারণ করলেন-
: দেওয়া রে! ডাইক্যা-ডুইক্যা ঘর ল’। আমার নয়নের পুত্তলি ঘরে ফিরুক, তারপর নামিস।
হে মেঘ! গর্জন করতে করতে তুই আকাশেই ফিরে যা। আমার আদরের সন্তান ঘরে ফিরুক, তারপর মাটিতে নেমে আসিস।
একজন নারী প্রেমিকা হিসেবে কিংবা স্ত্রী হিসেবে ভালোবাসার প্রতিদান হয়তো প্রত্যাশা করে। কিন্তু সেই নারী যখন মা হয়- মাতৃত্বের মহিমা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এই একটি ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এই একটি ক্ষেত্রে তার ত্যাগ, তার ভালোবাসার কাছে পুরুষের আত্মত্যাগ ও ভালোবাসা কিছুই না। আজ আমরা এতটাই আধুনিক- পরকীয়ার নেশায় নিজের পেটের সন্তানের মৃত্যু নিশ্চিত করতেও দ্বিধাবোধ করছি না। এখন আমরা এতটাই স্মার্ট- বিচ্ছেদকে বলছি ব্রেক-আপ। ভালোবাসায় আবার ব্রেক কী? ভালোবাসা কি কোনো লোকাল ট্রেন- স্টেশনে-স্টেশনে ব্রেক মারতে মারতে সামনে অগ্রসর হবে?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩