পদ্মাসেতুতে পরামর্শক নিয়োগে হওয়া দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রধান টার্গেট হিসেবে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করা না হলে পদ্মাসেতু প্রকল্পে কোন অর্থায়ন করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক এই ঋণদাতা সংস্থাটি।
এদিকে মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন চায় দেশের ১৬ কোটি মানুষ। এ অবস্থায় একদিকে পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন, অন্যদিকে সরকারের ইমেজ।
অনেকটা শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় উভয় সঙ্কটে পড়েছে সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন । আর এই উভয় সংকট নিয়ে সরকার ও দুদকের মধ্যেও দেখা দিয়েছে বিভাজন। ফলে সহসাই কোন সিদ্ধান্তেও আসতে পারছে না তারা। বিশ্বব্যাংকের চাপ যেমন সরকারের ওপর রয়েছে, তেমনি আছে দুদকের ওপরও।
সরকারের প্রভাবশালী একটি পক্ষ মনে করছে, নির্বাচনী ইশতেহার ও গণদাবি অনুযায়ী পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও বিশ্বিব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক।
অন্যদিকে আরেকপক্ষ মনে করছে, আবুলের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে সরকার চরম ইমেজ সঙ্কটে পড়বে। আর এই বিষয়কে পুঁজি করে বিরোধী দল জনগনের সামনে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপণের মাধ্যমে ফায়দা লুটবে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানকে নিয়ে অনেকটা একই ধরণের টানাপড়েন চলছে দুদকেও। সাবেক এ দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে কিনা, এ নিয়ে দুদক কমিশনারদের মধ্যেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
যা সম্প্রতি তাদের কিছু বিপরীতমুখী বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। গত পাঁচ ডিসেম্বর নাখোশ হয়ে বিশ্বব্যাংক প্যানেল ফিরে যাওয়ার পরদিন মামলা করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত মামলা করা হয়নি। আদৌ মামলা করা হবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা। এ বিষয়টি নিয়ে চতুর্মুখী চাপের মুখে মানসিকভাবে অসুস্থবোধও করছেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এবং তিনি তা অকপটে গণমাধ্যমে স্বীকারও করেছেন।
তবে দুদকের আইনবিধি ও বাস্তবতায় কমিশনের যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার গোলাম রহমানের একার নেই। তিনিসহ এখানে আছেন তিন সদস্যের কমিশন। সিদ্ধান্তের বিষয়ে আরও দুইজন কমিশনারের বিষয়টিও জড়িয়ে আছে। কমিশনে সবার মত আলাদা। তবে দুইজন যেদিকে মত দেবেন সেদিকে পাল্লা ভারি হবে।
অযোগ্য পরামর্শক সংস্থা এসএনসি-লাভালিনকে কার্যাদেশ দিতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীসহ ১০ জনের নামে গত দুই ডিসেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে দুদকের অনুসন্ধান কমিটি। বিশ্বব্যাংকের তিন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পদ্মাসেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুদকের মামলায় আবুল হোসেনকে আসামি করা নিয়ে ৪ ও ৫ ডিসেম্বর দুদকের সঙ্গে দেনদরবার করে।
বিশ্বব্যাংকের প্যানেলের সঙ্গে তিন দফা বৈঠকে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে আসামি না করার পক্ষে অবস্থান নেয় কমিশন। পরে তা শুধু সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। বিশ্বব্যাংকের প্যানেলকে দুদক জানায় যে, সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দালিলিক কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে তাকে আসামি করা সমিচীন নয়। তবে অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে দ-বিধি ১২০(খ) ধারায় মামলা করা যায়।
কিন্তু আবুল হোসেনকে আসামি না করার সিদ্ধান্তে সরাসরি আপত্তি জানায় বিশেষজ্ঞ প্যানেল। বিশ্বব্যাংকের দাবি হচ্ছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলায় সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনকে আসামি করতে হবে, তাকে জেলে পাঠাতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা দুদককে সাফ জানিয়ে দেন, আবুল ছাড়া মামলা হলে আর কোন আলোচনা নয়। পদ্মাসেতুতে অর্থায়নও সম্ভব নয়। এ অবস্থায় দুদকের সঙ্গে ঐক্যমতে না পোঁছায় অবশেষে নাখোশ হয়ে ঢাকা ত্যাগ করে বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল। এ বাস্তবতায় দুদক কি সিদ্ধান্ত নেয় সেদিকে তাকিয়ে আছে সবাই।
প্রসঙ্গত, পদ্মাসেতু দুর্নীতি ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ঘটনায় আবুল হোসেনসহ ১০ জনের নামে মামলার সুপারিশ করে তদন্ত টিম প্রতিবেদন দাখিল করলেও কমিশনে সর্বসম্মতভাবে বিষয়টি অনুমোদন হয়নি।
গোলাম রহমান প্রায়ই বলছেন, এ সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে যতবড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই জড়িত থাকেন না কেন, প্রমাণ পেলে মামলা হবে। জানা যায়, দুদক টিম কিছু তথ্যপ্রমাণ দিয়েই প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এতে আবুল হোসেনের বিষয়ে বলা হয়েছে, স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণেই তিনি এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছিলেন।
আর সেই কর্মকর্তাদের একজন হলেন, রমেশ সাহা (লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট)।
তার ডায়েরিতে ১০ পার্সেন্ট ঘুষের কথা লেখা আছে। আবুল হোসেনসহ
৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামও রয়েছে সেখানে।
সে অনুযায়ী সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানসহ এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তাদের দেখা করা, টেন্ডারে অযোগ্য হিসেবে প্রথমে বিবেচিত হওয়া প্রতিষ্ঠান হলেও পরে এসএনসি-লাভালিনকেই কার্যাদেশ দিতে চারবার টেন্ডার কমিটি পরিবর্তন করা, এসব তৎপরতা কিন্তু দুর্নীতির উদ্যোগেরই প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয় বলে দুদক টিম সুপারিশে উল্লেখ করে।