অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ আর পলাশী প্রান্তর যেন সমাথর্ক। পলাশী আর সিরাজের জন্য আজো বাঙ্গালীর মন কাঁদে। বাঙ্গালী জাতি যত দিন বেঁচে থাকবে ততোদিন পলাশী আর সিরাজের দুর্ভাগ্য তাদের কাঁদাবে।
নবাব সিরাজের প্রকৃত নাম মির্জা মুহাম্মদ। সিরাজ-উদ-দ্দৌলাহ ছিল উপাধি। অর্থ রাষ্ট্রের প্রদীপ। দাদু আলীবর্দীর স্বপ্ন ছিল সিরাজ ক্ষমতায় বসে রাষ্ট্রকে পাদপ্রদীপের আলোয় সজ্জিত রাখতে পারবেন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ভোর ৫টায় ইহকাল ত্যাগের আগে নবাব আলীবর্দী দৌহিত্র সিরাজকে নসিহত করেন- “প্রিয় সিরাজ, আমার যৌবনের শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। মৃত্যু সমাগত। আল্লাহর রহমতে তোমার জন্য একটি বড় রাজ্যের পত্তন করেছি। দেশের শত্রুদের দমণে তুমি মনোযোগী থেকো। বন্ধুদের প্রতি যথোচিত আচরণ করো। সমস্ত অমঙ্গল ও বিশৃঙ্খলা দূর করে প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি করো। ঐক্য সমৃদ্ধি আনে। অনৈক্য আনে দুঃখ। জনগনের শুভেচ্ছার উপরই রাজ্যের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিষয়ে আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করো। তাতে জীবদ্দশায় তোমার কোনো ক্ষতি হবেনা। মনে রেখো ঈর্ষা হলো বিষ। তাতে মনের সমৃদ্ধ বাগান শুকিয়ে যায়।” সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থে এ নসিহতের বিবরণ রয়েছে।
সিরাজ ১৭৩৩ সালে জন্ম গ্রহন করেন। আর ১৭৫৬ সালে দাদুর পরলোকগমনের পর মাত্র ২৩ বছর বয়সে মসনদে আরোহন করেন। ক্ষমতায় বসেই সিরাজকে বহুমাত্রিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। খালা ঘসেটি বেগমের অপরিসীম জিঘাংসা, খালাতো ভাই পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গের আমরণ শত্রুতা, ক্ষমতাশালী আমত্য জগৎশেঠ ও রাজভল্লবের জঘন্য অর্থগৃধূতা, প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের গোপন ষড়যন্ত্র সর্বোপরি বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নজীরবিহীন লোভের বলি হতে হয় তাকে। তিনি চারদিকে ব্যাপক ষড়যন্ত্র আর স্বার্থান্ধতার সুক্ষ জালে বিভ্রান্ত হন। শেষ পর্যন্ত সিংহাসন আর প্রাণ দুটোই দিতে হয়। আর এ দুঃখজনক ঘটনা ঘটে পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে। আসা যাক পলাশী প্রসঙ্গে।
পলাশী ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নদীয় জেলায় অবস্থিত। মুর্শিদাবাদ থেকে ৪৫ কিলো দক্ষিনে এবং কোলকাতা থেকে ১৫৪ কিলো উত্তরে ভাগীরথী নদীর তীরে এর অবস্থান। কোলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাবার পথে পলাশীতে একটি রেল স্টেশন রয়েছে। এখানে নেমে ঘন্টা খানেক হাটলেই মেলে পলাশী। সিএনজি করেও যাওয়া যায়। গত ফেব্রুয়ারীতে পলাশী প্রান্তর সরেজমিন পরিদর্শনে পা যুগলকে সম্বল করেছিলাম। পলাশীর প্রকৃত নাম লক্ষ বাগ। সারি সারি লাখো আম গাছের সমাহার ছিল। এখনো রয়েছে। লক্ষ বাগ থেকে পলাশী গ্রামের দূরত্ব এক কিলো। আমবাগানের উত্তর ও পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। এতো বড়ো মাঠ জীবনেও দেখিনি।
পলাশী গ্রামের সাথেই মঙ্গোর পাড়া। এই মঙ্গোরপাড়ার নবাব দীঘির পাশেই ছিলো মাটির ঢিবি ও লম্বা পাড়। এর আড়ালেই নবাব সিরাজ যুদ্ধ ছাউনী ফেলেছিলেন। ছাউনী থেকে প্রায় দুই কিলো দীর্ঘ পরীখা খনন করে নবাবের নিজস্ব বাহিনী পলাশী যুদ্ধের জন্য সেদিন প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সেই দীঘি এখন বিলুপ্তপ্রায়। তবুও দীঘির ধার ধরে ঘন্টা খানেক হেটে বেড়িয়েছি নবাব সিরাজকে স্মরণ করে। কেমন যেন শিহরণ অনুভব করছিলাম। পঞ্চম শ্রেণীর সমাজ পাঠে পলাশীর কাহিনী পড়েছি। হতভাগ্য সিরাজের করুণদশায় চোখের জল ফেলেছি, তেমনি বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে ঘৃণা করতে শিখেছি।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের সময় বাংলার প্রাচীন রাজধানী মুর্শিদাবাদ জেলা পূর্ব বাংলার ভাগে পড়েছিলো। কিন্তু স্যার সিরিল রেডক্লিপের নতুন মানচিত্র ভাগবাটোয়ারার কূটচালে পূর্ব বাংলা মুর্শিদাবাদ লাভে বঞ্চিত হয়। সুতরাং আর দশ জন বাংলাদেশী বাঙ্গালীর মতো পলাশী পরিদর্শনে আবেগ তাড়িত ছিলাম। পলাশী যুদ্ধ শুরুর পর নবাব সামরিক পরিস্থিতি দেখার জন্য যেসব স্থান পরিদর্শন করেছিলেন, সম্ভাব্য সে সব স্থানগুলো মনোযোগ দিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সামরিক প্রধান লর্ড ক্লাইভ পলাশী যুদ্ধে আম বাগানের যে স্থানে যুদ্ধ শিবির স্থাপন করেন তার সন্নিকটে একটি মনুমেন্ট রয়েছে।
এবার আসা যাক পলাশী যুদ্ধের শক্তিসাম্য সম্পর্কে। ১৭৫৭ সালের ২১ জুন নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে নিজস্ব সেনাবাহিনী নিয়ে পলাশী প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। ইংরেজরা এর এক দিন পর আম বাগানে ঘাটি গাড়েন। নবাব সিরাজের নিজস্ব বাহিনীতে ছিল পাঁচ হাজার মুঘল ঘোড়সওয়ার, সাত হাজার পদাতিক এবং দুটো মাত্র কামান। বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ মীর মদন, মোহনলাল, নোহা সিং আর বাহাদুর আলী খান। নবাবের বাহিনীর সাথে ৪৫ জন ফরাসী সৈন্য এবং চারটি হালকা কামান নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন মঁিসয়ে সিনফ্রে। সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, ইয়ার লতিফ ও রায়দুর্লভের অধীনে ছিল ৩৫ হাজার সৈন্যের মূল বাহিনী। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে এ বাহিনী সেদিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে নিরাপদ দুরত্বে পুতুলের মতো দাড়িয়ে ছিল।
অপর দিকে লর্ড ক্লাইভের পক্ষে ছিল লাল কুর্তা সাদা ক্রস আর বেল্ট পড়া ১১০০ ইংরেজ পদাতিক ও গোলন্দাজ, ২১০০ ভারতীয় সিপাই এবং তিনশতাধিক লস্কর। ইংরেজ সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে ছিলেন লর্ড ক্লাইভ, মেজর কিল প্যাট্রিক, ক্যাপ্টেন আর্কিবল্ড গ্রান্ট, আয়ার কুট এবং ভারতীয় ক্যাপ্টেন গোপ। ২৩ জুন খুব ভোরে আম বাগানের সামনে উত্তরমুখো হয়ে ইংরেজ সেনারা যুদ্ধের জন্য দাড়ান। আর নবাবের সৈন্যরা মঙ্গোরপাড়ার দীঘির পরিখা এবং মূল শিবির থেকে বেরিয়ে কুঁচকাওয়াজ করে পলাশী মাঠের উত্তর প্রান্তে দক্ষিন মুখো হয়ে অর্ধবৃত্তাকারে দাড়ান। সকাল আটটায় নবাব শিবিরে যুদ্ধের দামাম বেজে উঠে। মঁসিয়ে সিনফ্রে প্রথম গোলা ছুড়ে যুদ্ধের সূচনা করেন। নবাবের গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনী আক্রমন চালালে ৩০জন ইংরেজ সৈন্য প্রাণ হারায়।
বেগতিক দেখে ক্লাইভ পিছু হটে আমবাগানের বাঁধের আড়ালে পজিশন নিয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করেন। উভয় পক্ষে গোলাগুলির মধ্যে সকাল ১১টায় মুষল ধারায় বৃষ্টি নামে। পলাশী মাঠে পানি জমে যায়। নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর বারুদ বৃষ্টিতে ভিজে ব্যবহারানুপযোগি হয়ে পড়ে। দুপুর বারোটায় বৃষ্টি থামলে মিরমদন অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমন চালান। কিন্তু ঘোড়ার পা কাদায় আটকে যেতে থাকায় তারা ইংরেজের গোলাবর্ষণের শিকার হয়। গোলায় নিহত হন মিরমদন, বাহাদুর আলী খান ও নোহা সিং। তবু ও নবাব বাহিনীর আক্রমনে ইংরেজরা আমবাগানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এদিকে লড়াই শুরুর পরই মীরজাফরের নের্তৃত্বে মূল বাহিনী দ্রুত যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে। প্রধান সেনাপতির এ আচরণে নবাব ভড়কে যান।
সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থের বিবরণ এরকম- “নবাব বুঝতে পারলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। এজন্য জরুরী মূহুর্তে মীরজাফর আলী খানকে বহুকষ্টে নিজ শিবিরে ডেকে আনেন। নিজের রাজকীয় পাগড়ী মীর জাফরের পায়ে রেখে বলেন, ‘মনে কোনো কষ্ট থাকলে আজ ভুলে যান। দেশের স্বার্থে পাগড়ীর সন্মান রক্ষা করুন।’ মীরজাফর পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে দেশ রক্ষায় যুদ্ধের শপথ নিলেন। তবে শর্ত দিলেন আজকের মতো যুদ্ধ বন্ধ রাখা হোক। আগামীকাল সকালে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ করবো।” সেই আগামীকাল আর কখনোই আসেনি। মীরজাফরও আর যুদ্ধে নামেননি।
সেনাপতি মোহন লাল মীরজাফরের এ প্রস্তাবে রাজি না হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নবাবকে অনুরোধ করেন। কিন্তু অস্থির নবাব পরামর্শ না শুনে অকস্মাৎ যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন। এতে নবাব বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সিরাজের অস্থির মানসিকতা আঁচ করতে পেরে আমত্য দুর্লভ রাম রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এভাবে এক বিশ্বাসঘাতক নবাবকে যুদ্ধ থামাতে বললেন। আরেক বিশ্বাস ঘাতক তাকে পালাতে বললেন। মির মদনের মৃত্যু এবং প্রধান সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় হতাশ নবাব বিকাল চারটায় দুহাজার অশ্বারোহী সৈন্যের পাহারায় দ্রুতগামী উটে রাজধানী অভিমুখে রওনা হন। পিছনে পড়ে থাকে পলাশী, একদল নেমক হারামের হাতে এক দেশপ্রেমিকের হেরে যাওয়ার সাক্ষী হয়ে।
প্রতিবেদক : দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এর এডিটর এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩