বাংলার নবাব সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের দোসর ছিলেন নেমকহারাম জগৎশেঠ। ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতা তার রক্তমাংসের সাথে মিশে গিয়েছিল। ঘৃণিত কাজে পাপের ষোল কলা পূর্ণ হলে একদিন তিনি কঠিন শাস্তি ভোগ করেন। ‘পলাশীর অজানা কাহিনী’ গ্রন্থে জগৎশেঠ সম্পর্কে নিন্মরুপ বর্ণনা দিয়েছেন পশ্চিম বঙ্গের গবেষক সুশীল চৌধুরী। তাতে বলা হয়- ‘স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রার বস্তা সারি সারি রেখে জাজিম সর্বোপরি নরম বিছানা সাজিয়ে শয্যা পাততেন তিনি। ধুতি আর পাঞ্জাবী ছিল তার প্রিয় পোষাক। রাজকীয় মর্যাদার পর পাঞ্জাবীর উপর চাপাতেন জরীর নকশাদার ঝলমলে শেরওয়ানী। মাথায় হিরাখচিত পাগড়ি। গলায় কোটি টাকার চুন্নি, স্বর্ণ ও জহরতের পুঁতিমালা। ছিল শত জোড়া স্বর্ণখচিত পাদুকা, হাতের দশ আঙ্গুলের সাতটিতে নানা কিসিমের অঙ্গুরী এবং কানে দামি কর্ণকুশি।
জৈন ধর্মাবলম্বি হওয়ায় আহার-বিহারে ছিলেন সংযমী। কথা বলতেন নিচু স্বরে। ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী ও ফর্সা। রাজকীয় আদবকায়দায় সিদ্ধহস্ত। নিজস্ব টাকশালে মুদ্রা বানাতেন। বলা হতো টাকার কুমির। তবে স্বভাবে উঁকি দিতো শঠামি, ধূর্ততা ও প্রতারণা। এজন্য হাজারো যশখ্যাতির পরও স্বভাবজাত বদগুণে বিশ্বাসঘাতকতাকে অগ্রে স্থান দিতেন। পলাশী যুদ্ধ ও নবাব সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পরও অপকর্ম থেমে থাকেনি। দুঃকর্মের সাথী মীরজাফর এবং মীর কাশিম পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। তাই শেষ পরিণতি দুর্গের ছাদ থেকে হাতপা বেঁেধ গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয় জগৎশেঠকে।
বাংলা শেঠ অর্থে বণিক, সওদাগর, বড় ব্যবসায়ী বা হিন্দু ব্যবসায়ীদের পদবী বুঝায়। বাংলার নবাবী আমলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে জুড়ে রয়েছেন শেঠরা। নবাব সিরাজের সাথে বেঈমানী করায় শেঠ নামের সাথে শঠ বা শঠামি যুক্ত হয়। এটি এখন ঘৃণা অর্থে প্রকাশ হয়। বাংলার শেঠদের আাদি পুরুষ হীরানন্দ সাহু। ভারতের যোধপুর থেকে ভাগ্যান্বষণে আসেন বিহারের পাটনায়। ব্যবসা থেকে ক্রমান্বয়ে কোটি টাকার মালিক। সাত পুত্রকে রাজধানী দিল্লীসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে পৃথক গদীতে (ব্যবসায়িক সেন্টার) বসান। হীরানন্দের কনিষ্ঠ পুত্র মানিক চাঁদ ছিলেন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খানের বিশ্বস্ত। মুর্শিদকুলি মুর্শিদাবাদ নগরীর গোড়াপত্তন করে বাংলার রাজধানী ঘোষনা দেন। তিনি মানিক চাঁদের পরামর্শে মুর্শিদাবাদে টাকশাল স্থাপন করেন। এটি দেখাশোনার দায়িত পান মানিকচাঁদ। এভাবেই শেঠ পরিবার বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল নিয়ন্তা হয়ে উঠেন।
১৭২২ সালে অপুত্রক মানিক চাঁদ মারা গেলে ভাগ্নে ফতেচাঁদ গদীর মালিক হন। ১৭২৪ খৃ. মুঘল স¤্রাট মোহাম্মদ শাহ বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে ফতেচাঁদকে রাজকীয় ফরমানবলে ‘শেঠ’ উপাধি দেন। এরপর শেঠদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। নবাবী দরবারে দাপট বেড়ে যায়। পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দীন, সরফরাজ খাঁন, আলীবর্দী পর্যন্ত নবাব বানানো আর নামানোর ভূমিকায় অবতীর্ন হন। ১৭৪৪ সালে জগৎশেঠ ফতেহচাঁদ মারা যান। গদীতে বসেন পৌত্র মহাতপচাঁদ। তিনিও কোটি টাকার বিনিময়ে মুঘল স¤্রাটের নিকট থেকে জগৎশেঠ উপাধি নিয়ে আসেন।
এ মহাতপচাঁদই হলেন আজকের আলোচ্য জগৎশেঠ। বলা হয়ে থাকে জগৎশেঠের গদীতে প্রতিদিন দশ কোটি টাকার কারবার হতো। দেশি রাজা-বাদশা ছাড়াও ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচ বনিকরা টাকা বিনিময় বা ধার দেনায় জগৎশেঠের গদীতে আসতো। বাংলার টাকশাল থেকে সে সময়ে সোনা, রুপা ও তামা এ তিন ধরনের মুদ্রা বাজারে ছাড়া হতো। এছাড়াও বত্রিশ রকমের মুদ্রা বাজারে প্রচলিত ছিল। নবাবের অনুমতি নিয়ে জগৎশেঠ বছরে ৫০/৬০ লক্ষ টাকার মুদ্রা টাকশালে বানাতেন। জগৎশেঠ মুদ্রা বিনিময়, টাকশালে মুদ্রা বানানো এবং সিক্কা ব্যবস্থা থেকে কোটি কোটি টাকা আয়রোজগার করতেন। সুদ ও লগ্নী ব্যবসাতো ছিলই। এমন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে নবাব সিরাজের সংঘাত শুরু হয় ক্ষমতারোহনের পরপরই।
সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থেও এর সবিস্তার বিবরণ দেখা যায়। আলীবর্দীর পরলোকগমনের পর সিরাজ মসনদে বসেন। নিয়ম অনুযায়ী নতুন নবাব ক্ষমতারোহনের পর দিল্লীর মুঘল রাজদরবার থেকে ফরমান (স্বীকৃতি) আনতে হতো। সাধারনত এ ফরমান আনার কাজ করতেন জগৎশেঠরা। কিন্তু সিরাজের ক্ষমরোহনের মাসাধিকাল পেরিয়ে গেলেও ফরমান আনতে টালবাহানা করেন জগৎশেঠ। নেপথ্যে ছিলেন ঘসেটি আর মীরজাফর। এরা সিরাজের পরিবর্তে তার খালাতো ভাই শওকত জং এর পক্ষাবলম্বন করেন এবং শওকত জং এর পক্ষে দিল্লীর মুঘল দরবারে তদবির করার দায়িত্ব দেন জগৎশেঠকে।
নবাব সিরাজ গুপ্তচর মারফত এ খবর জানতে পেরে রাজদরবারে জগৎশেঠকে প্রকাশ্যে ভৎর্সণা করেন। এভাবেই জগৎশেঠের সাথে নবাব সিরাজের দুরত্ব তৈরি হয়। ক্ষমতারোহনের ছয় মাসের মাথায় সিরাজ প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, হাকিম বেগ, রায়দুলর্ভের ক্ষমতা ছেঁেট দেন। সম্ভবত মীরজাফরের অনুগামী জগৎশেঠ এতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কারণ নতুন নবাব জগৎশেঠের সব অবৈধ আয়ের উৎস বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারেন এ ভয় কাজ করছিলো। অবশ্য জগৎশেঠের নিজের সামরিক ক্ষমতা একেবারে তুচ্ছ ছিলনা। মুঘল দরবারে নিয়মিত উপঢৌকন দেয়ার সুবাদে পরিবারের নিরাপত্তায় দুই হাজার অশ্বারোহী নিজ খরচে রাখার অধিকার সংরক্ষন করতেন জগৎশেঠ। এ বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইয়ারলতিফ। যিনি পলাশী ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠের অনুগামী ছিলেন।
পলাশী যুদ্ধের আগে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে মীরজাফর গং এর ষড়যন্ত্রের জাল বুনার নেপথ্যে ছিলেন জগৎশেঠ। তিনি মীরজাফরকে প্ররোচিত করে বিপুল অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধে নামান। উৎকোচের বড় অংশ জগৎশেঠ বহন করবেন বলেও আশ্বস্ত করেন। কিন্তু পলাশী যুদ্ধ শেষ হলে জগৎশেঠ কানাকড়িও দেননি। বরং ঘসেটি বেগমের মতিঝিল এবং নবাব সিরাজের হিরাঝিল প্রাসাদে লুট করে বড় অঙ্ক পকেটস্থ করেন জগৎশেঠ।
মীরজাফর ক্ষমতায় বসার পর জগৎশেঠ মুখ ঘুরিয়ে নেন। নতুন বন্ধু হিসাবে বেছে নেন লর্ড ক্লাইভকে। রাজভান্ডার লুটপাটের ফলে ক্ষমতায় বসে মীরজাফর ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে অপারগ হন। আর তখনি ইংরেজরা স্বমূর্তিতে আর্বিভূত হন। দুই বছরের মাথায় মীরজাফরকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে তদীয় জামাতা মীর কাশিমকে বাংলার মসনদে বসান। এ ক্ষেত্রেও অনুঘটক ছিলেন জগৎশেঠ।
মীরকাশিম বাংলার নবাব হবার পর ইংরেজদের সাথে নানা কারণে দুরত্ব তৈরি হয়। জগৎশেঠ এ বিরোধকে উসকে দিয়ে নিজের ফায়দা লুটার ছক আঁকেন। ক্ষুব্দ মীরকাশিম জগৎশেঠকে বন্দী করেন। ১৭৬৪ সালে বক্সার যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে পরাজয় বরণের পর মীরকাশিম জগৎশেঠকে হত্যার নির্দেশ দেন। হাতপা বেঁধে মুঙ্গের দুর্গের ছাদ থেকে গঙ্গায় ফেলা হয় জগৎশেঠকে।
আর এ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে বাংলার ষড়যন্ত্রের ইতিহাসের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। বিশ্বাসঘাতকরা কখনো শাস্তি থেকে রেহাই পাননা। জগৎশেঠের সলিল সমাধির ঘটনা তার জীবন্ত উদাহরণ।
প্রতিবেদক :
দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা, এডিটর, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩