অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : নবাব আলীবর্দীর জ্যাষ্ঠ কণ্যা ঘসেটি স্বামী নওয়াজেশ খানকে নিয়ে সুখি ছিলেন না। নওয়াজেশ ছিলেন সম্পর্কে কাকাতো ভাই। বাল্যে এক সাথে বেড়ে উঠেছেন। মানুষ হয়েছেন। তাই বিয়ের পর সুন্দরী ঘসেটি স্বামী নওয়াজেশকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। ‘মেমোয়েরস অব মঁসিয়ে লা’ গ্রন্থের বিবরণ এরকম, ‘রাজকুমারির সাথে নওয়াজিশের বয়সের ব্যবধান ছিল ১৫/১৬ বছর। নওয়াজিশ ছিলেন রাশভারি, স্বল্পভাষী, গুমরামুখো ও কর্কশ স্বভাবের। কদাচিৎ হাসতেন তিনি। ঘরে সুখ ছিলনা বলে রাজকাজ শেষে বাঈজী মহল অথবা বন্ধুদের সাথে লম্বা আড্ডা দিতেন তিনি। সব সময় পারসীয়ান সুরা পছন্দ করতেন। রাজ প্রাসাদে ফিরতেন অনেক রাতে। জেনানা মহলের খোঁজ নিতেন না সহজে। রাজস্ব আদায়ের অছিলায় প্রায়ই ঢাকায় যেতেন। সেখানেই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। অপরদিকে ঘসেটি ছিলেন সদা হাসোজ্জল, স্বভাবে বাকপটু, বিলাসিতায় বেপরোয়া, সাজুগুজুতে অতুলনীয় এবং ভোগবিলাসে অপ্রতিদ্বন্ধি। এ বিপরীত চরিত্রের দম্পতির জীবন সুখের হওয়ার কথা নয়। এ সুযোগ নেন টগবগে সুদর্শন পারসীয়ান যুবক হোসেন কুলি খান।’
নবাব আলীবর্দীর কোনো পুত্র সন্তান ছিলনা। জ্যাষ্ঠ কণ্যা ঘসেটির ধারনা ছিল নবাবের পরলোকগমনের পর তার সন্তানরাই হবে মুর্শিদাবাদের উত্তরাধিকারি। আর তিনি হবেন সকল দন্ডমুন্ডের কর্ত্রী। কিন্তু বিবাহের এক দশক পরেও সন্তানসন্ততী না হওয়ায় হতাশ হন ঘসেটি। স্বামী নওয়াজেশকে এ জন্য দায়ী করেন। এনিয়ে মান অভিমান এতটাই বেড়ে যায় যে, বেগম শরীফুন্নেসা শেষ পর্যন্ত তাতে হস্তক্ষেপ করেন। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এদিকে একবার মহরম মাসের এক রাজকীয় ভোজ সভায় ঘসেটির নজরে পড়েন হোসেন কুলি খান। হোসেন তখন নবাবের অশ্বারোহী বাহিনীর তরুন সেনাপতি। মারাঠা দমনে সাহসিকতার পরিচয় দেয়ায় আলীবর্দী তাকে ¯েœহের চোখে দেখতেন। ভোজের আগে প্রচলিত রীতিনুযায়ী নবাবকে বিশেষ কায়দায় সম্মান জানানো হতো। আর সেদিন চৌকষ সেনাপতি হোসেন কুলি শৈল্পিক কায়দায় রাজকীয় সম্মান ও কুর্ণিশ জানান। ভোজ অনুষ্ঠানে খোদ নবাব তার প্রশংসা করেন। হোসেন ছিলেন অবিবাহিত। সুন্দর মুখাবয়ব ছাড়াও অপরিসীম দৈহিক সৌন্দর্যের অধিকারি ছিলেন তিনি। আলীবর্দীই সেদিন পরিবারের সকল সদস্যের সাথে হোসেন কুলির পরিচয় করিয়ে দেন। এতে সর্ব মহলে হোসেন কুলির সম্মান বেড়ে যায়। মুর্শিদাবাদের কেল্লায় চাকরি স্থায়ী হয়ে যায়।
এক ঈদে মিলাদুন্নবীর এক অনুষ্ঠানে ঘসেটির সাথে হোসেন কুলির দ্বিতীয় বার মোলাকাত ঘটে। দেখা থেকে কথা। সেই দেখা আর কথা শেষ পর্যন্ত প্রণয়ে রুপ নেয়। ফার্সি ভাষায় বলা হতো ‘বেআব্রু মহব্বত’। হোসেন ছিলেন ঘসেটির পাঁচ বছরের ছোট। বয়সে বিশ বছরের বড় নওয়াজেশ খানের সাথে অসম বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন তিনি। আর বন্ধুত্বের ফজিলতে ঘসেটি মহলে অবাধ গমনের ফায়দা নেন। সমসাময়িক কবিয়াল গানের বরাত দিয়ে, ‘মুর্শিদাবাদের জেনানা মহল’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রতি দিন ভোরে অশ্বরোহী বাহিনীর কুঁচকাওয়াজ হতো ছোটকাটরা মাঠে। হোসেন কুলি ওই কুঁচকাওয়াজের স্থান পরিবর্তন করে ভাগীরথির পশ্চিম পাড়ে মতিজিল প্রাসাদের দুইশ গজ দুরের খোলা মাঠে নিয়ে যান। কুঁচকাওয়াজ শেষ হলে মতিজিল প্রাসাদে তিনি ঘসেটির সাথে আড্ডা দিতেন।’
এর আগে ঘসেটির জেদাজেদিতে আলীবর্দী ভাগীরথি নদীর পশ্চিম পাড়ে মতিঝিল প্রাসাদ নির্মাণ করে দিতে বাধ্য হন। নওয়াজেশ অধিকাংশ সময় ঢাকায় অবস্থান করায় ঘসেটি মতিঝিল প্রাসাদের ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পান। হোসেন কুলি আর ঘসেটির এ অবৈধ প্রণয় কখনোই ইতিহাসের খোরাক হতোনা, যদি না সিরাজের বিধবা মাতা আমেনা বেগমের সাথেও সম্পর্ক না জড়াতো। সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘সিয়ার’ এ সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘১৭৪৮ সালে বিহারের পাটনায় বিদ্রোহী পাঠান সেনাপতি শমসের খানের অতর্কিত আক্রমনে সিরাজের পিতা জয়েন উদ্দীন নিহত হন। বিধবা আমেনার স্থান হয় আলীবর্দীর বেগম মহলে। তবে ঘসেটির মতিজিলে যাতায়াতের এক পর্যায়ে হোসেন কুলির নজরে পড়েন আমেনা। আর র্দুবৃত্ত হোসেন কুলি ঘসেটিকে রেখে আমেনার সাথে প্রণয়ে লিপ্ত হন। ধিক হোসেন কুলিকে।’
সমসাময়িক ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘মোজাফফর নামা’ তে বলা হয়, “ঘসেটির অবৈধ প্রণয় ভাগীরথির উভয় পাড়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশি দিন লাগেনি। এক কান দু’কান করে তা আলীবর্দীর কানে পৌঁছালো। এ কলঙ্ক কনিষ্ঠা কণ্যা আমেনাকেও স্পর্শ করলে আলীবর্দী বিচলিত হয়ে পড়েন। আমেনার সাথে প্রণয়ে লিপ্ত হওয়ায় ঘসেটি এক পর্যায়ে হোসেন কুলির উপর ক্ষুব্দ হন। তিনি বেগম শরীফুন্নেছার নিকট হোসেন কুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। নবাবের পাশাপাশি নবাব পত্মী শরীফুন্নেছাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। অতএব হোসেন কুলিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দায়িত্ব পড়ে তরুন সিরাজের উপর।
সমসাময়িক “মুর্শিদাবাদ কাহিনী” গ্রন্থে এর বিবরণ দেখুন, ‘সিরাজ স্বীয় জননীর কলঙ্কের কথা শুনে মর্মাহত হন। আলীবর্দী আর শরীফুন্নেছা উপান্তর না দেখে নবাব মহলের পরম শত্রু হোসেন কুলির বিনাশ সাধনে সিরাজকে উত্তেজিত করলেন। সেনাপতি হত্যার দোষক্ষালনের জন্য আলীবর্দী শিকারচ্ছলে রাজমহল গমন করলেন। আর সিরাজ হোসেন কুলি খানকে প্রকাশ্যে হত্যা করে মনের জ্বালা নিবারণ করলেন।’ ‘মোজাফর নামা’য় বলা হয়েছে, “নিজের পুত্র না থাকলেও ঘসেটি সিরাজের সিংহাসন লাভের পথ কন্টকাকীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য দত্তক পুত্র প্রয়াত ইকরামদ্দৌলাহর পুত্র দেড় বছরের মুরাদউদ্দৌলাহকে উত্তাধিকারি মনোনয়নের জন্য বায়না ধরেন। এ কাজ সফল করার জন্য তরুন সেনাপতি হোসেন কুলির সাথে অবৈধ প প্রণয়ে লিপ্ত হন।”
হোসেন কুলির মাধ্যমে লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় ঘসেটি পরবর্তীতে আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েন। আলীবর্দীর পরলোকগমন এবং সিরাজের সিংহাসন লাভের পর ঘসেটি রাজা রাজবল্লভের সাথে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হন। নবাবী লাভের আশায় রাজবল্লভের মাধ্যমেই কোলকাতায় ইংরেজ কুঠিরে যোগাযোগ রাখতেন। ািব্রটিশ ঐতিহাসিক অরমি ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা পর্ব’ গ্রন্থে রাজবল্লভের সাথে ঘসেটির অবৈধ প্রণয়ের উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক ‘সিয়ার গ্রন্থের’ অনুবাদক হাজী মোস্তফা ঘসেটিকে বারাঙ্গনার সাথে তুলনা করেছেন। পলাশী যুদ্ধের পর ঘসেটির সব স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। রাজপ্রাসাদ লুন্ঠন করেন মিরণ। সঙ্গে যোগ দেন কয়েকশ ইংরেজ সৈন্য। ঘসেটিকে মতিঝিল প্রাসাদ থেকে ন্যাক্কারজনক ভাবে টেনে হিচড়ে বের করা হয়। জেনানা মহলের শতাধিক বাদীকে ভাগ করে নেয় মিরণ আর ইংরেজ সিপাহীরা। লালবাগের একটি জীর্ণ বাড়িতে ঘসেটিকে বন্দী করে রাখা হয়। দুদিন অভূক্ত রাখার পর বেগম শরীফুন্নেছা, সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজ পতœী লুৎফন্নেছাসহ হেরেমের অর্ধশতাধিক নারীকে নৌকায় পাঠানো হয় ঢাকার জিঞ্জিরায়। তার পর কিভাবে ঘসেটি আর আমেনাকে নৌকায় বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে সলিল সমাধি দেয়া হয় তা সবার জানা।
প্রতিবেদক : দৈনিক ইত্তেফাক গোপালপুর সংবাদদাতা, এডিটর, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩