বাংলার প্রাচীন রাজধানী মুর্শিদাবাদের একাল-সেকাল (৪)
অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন : বাংলার আরেক ঘৃনিত চরিত্রের নাম ঘসেটি বেগম। মীরজাফরের কুকর্মের বিশ্বস্ত সঙ্গী। পুরো নাম শাহজাদী মেহেরেুনেচ্ছা। বাংলার নবাব আলীবর্দি খানের জ্যাষ্ঠ কণ্যা। জন্ম ১৭০৯ সালে দিল্লীর আগ্রায়। বাবা আলীবর্দি তখন দিল্লীতে মুঘল বাহিনীতে কর্মরত। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা থাকায় মুঘলদের সেই পতন যুগে পারসীয়ান জাতি-গোষ্ঠিভূক্ত আলীবর্দির যাতায়াত ছিল মুঘল দরবারে। এ সুযোগে অভিজাত মুগল ও আমত্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পান পরিবারের সদস্যরা। রাজকীয় আদকায়দার পাশাপাশি মুঘল হেরেমের ভোগবিলাস ও ঐশ্বর্য্যের সাথে পরিচিয় ঘসেটির। ১৭২০ সালে আলীবর্দি চলে আসেন বাংলায়। ঘসেটি তখন কিশোরী। বাংলা ছিল তখন ভারতবর্ষের সব চেয়ে ধনসম্পদে পূর্ণ রাজ্য। শাসক ছিলেন নবাব সুজাউদ্দীন। তার অধীনে সামরিক বিভাগে চাকরি আলীবর্দির। প্রথমে বিহারের পাটনায়। পরে রাজমহলের ফৌজদার হন। দিন কেটে যায়। আর আলীবর্দির ভাগ্য সুপ্রশন্ন হতে থাকে। জ্যষ্ঠ ভ্রাতা আহমদ আলী খান এ সময়ে দিল্লী থেকে চলে আসেন বাংলায়। তিনিও আলীবর্দির সুপারিশে চাকরি পান। সুজাউদ্দীনের পর নবাব হন সরফরাজ খান। তিনি ছিলেন অত্যাচারি। তাকে পরাস্ত করে আলীবর্দি ১৭৪০ সালে বাংলার মসনদে বসেন। এভাবে আলীবর্দি যুগ শুরু। আলীবর্দির তিন কণ্যার বিয়ে দেন জ্যষ্ঠ ভ্যাতা আহমদ আলী খানের তিন পুত্রের সাথে। বড় মেয়ে ঘসেটির বিয়ে হয় নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের সাথে। দ্বিতীয় কণ্যা মায়মুনার সাঈদ আহমেদ খানের এবং তৃতীয় কণ্যা আমিনা বেগমের জয়েনউদ্দীন আহমদ খানের সাথে। ১৭২১ সালে বিহারে নওয়াজিশের সাথে ঘসেটির বিয়েতে প্রচুর খরচ করেন আলীবর্দি। স্বর্ণের পালঙ্কে বাসর উদযাপন করেন ঘসেটি। দুশো বাদীকে আঁচল ভরে স্বর্ণৃমুদ্রা উপহার দিয়ে সাড়া জাগান। পরে আলীবর্দি নবাব হলে ঘসেটি স্বামী নওয়াজিশের সাথে চলে আসেন মুর্শিদাবাদে। ঘসেটি দেখতে ছিলেন খুব সুশ্রী। গায়ে দীর্ঘাঙ্গী। রংয়ে ফর্সা। উন্নত নাক, চওড়া ভূরু ও লম্বা কেশ ছিল ঈর্ষার বস্তু। সব সময় সেজেগুজে থাকতেন। ব্যক্তিগত দাসী ও ভৃত্যদের সামনে এলামেলো অবস্থায় সাক্ষাত দিতেন না। পারসীয়ান গোলাপের খুশবু ও আতর ব্যবহারে অভ্যস্থ ছিলেন। দিল্লী থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আসতো তার বিলাস সামগ্রী। স্বামী নওয়াজিশ ছিলেন ঢাকার তথা পূর্ব বাংলার নায়েব নাজিম। রাজকাজের জন্য সেখানেই অবস্থান করতেন। নিঃসন্তান ঘসেটি থাকতেন মুর্শিদাবাদের মতিঝিল প্রাসাদে। সেখানেই সেনাপতি হোসেন কুলি খানের সাথে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হতেন ইতিহাসের খল নায়িকা ঘসেটি। বিষয়টি মুর্শিদাবাদ নগরীর অভিজাত মহলে জানাজানি হলে বিব্রত অবস্থায় পড়েন নবাব আলীবর্দি খান। নবাবী মহলের মুখ রক্ষায় তিনি হোসেন কুলি খানকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার আদেশ দেন দৌহিত্র সিরাজকে। গুপ্ত হত্যার ইঙ্গিত থাকলেও অল্প বয়সী সিরাজ উত্তেজনা বশত কাজটি করেন প্রকাশ্যে। ১৭৫২ সালের এপ্রিল মাসে ঘসেটির প্রাসাদ থেকে বেসামাল অবস্থায় বেরিয়ে আসার সময় আটক করেন হোসেন কুলি খানকে। বেইজ্জতির পর নগরীর প্রধান সড়কে ভরদুপুরে তার শিরচ্ছেদ করা হয়। ঘসেটি বেগম প্রেমিক হত্যার ঘটনায় প্রচন্ড ক্ষুব্দ হন। কিন্তু রাজরোষের ভয়ে পিতা আলীবর্দির বিরুদ্ধে টু শব্দ করার সাহস পাননি। তার সব ক্রোধ জমা হয় সিরাজের বিরুদ্ধে। আর সে ক্রোধানল মেটান মীরজাফরের সাথে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে। আগামী পর্বে ঘসেটি বেগমের নিষিদ্ধ প্রেম, (বেআব্রু মহব্বত) ও পরিণতি তুলে ধরা হবে।
ছবি : মুর্শিদাবাদের ভাগীরথি নদীর পশ্চিম পাড়ে খোশবাগে কৃষ্ণ পাথরে মোড়াই করা ঘসেটি বেগমের এ সমাধিকে পর্যটকরা কখনো সম্মানের চোখে দেখেনা। ঘৃণায় জুতো পায়ে কবরের টাইলস মাড়াতে দেখা যায় অনেককে।
প্রতিবেদক : এডিটর, গোপালপুর বার্তা ২৪ ডট কম, দৈনিক ইত্তেফাক গোপালপুর সংবাদদাতা এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩