- জয়নাল আবেদীন
[caption id="attachment_16068" align="alignright" width="534"] সস্ত্রীক হেমনগর জমিদারের শেষ নায়েব গণেশ রক্ষিত ও প্রতিবেদক জয়নাল আবেদীন। ফটো : কে এম মিঠু[/caption]
গণেশ রক্ষিত। বয়স ১১৩। হেমনগর জমিদারের শেষ নায়েব। কালের সাক্ষি হয়ে বেঁচে আছেন এখনো। হেমনগর জমিদার বাড়ি থেকে দুই কিলো দক্ষিন-পশ্চিমে শাখারিয়া গ্রামের বাড়িতে সস্ত্রীক বাস করেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ইতিহাসের পাল্টা উল্টিয়ে হেমনগর অধ্যায়ের ডালি মেলে ধরেন।
জানান, ১৯০২ সালে জন্ম। বাবা গিরিশ চন্দ্র রক্ষিতের হাত ধরে বাল্যে জমিদার বাড়ির শারদীয় পুঁজা দেখতে যেতেন। তার ভাষায়, ‘ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, ঢাকডোল ও কাসার শব্দে জমিদার বাড়ি মোহনীয় হয়ে উঠতো। জমিদার হেমচন্দ্র দীর্ঘাঙ্গী ও ফর্সা ছিলেন। গায়ে দামি পোষাক জড়াতেন। হাতে কয়েকগুচ্ছ স্বর্ণ ও দামি পাথরের আংটি এবং গলায় মুক্তোর মালা ঝুলতো। স্বর্ণের পাত মোড়ানো চপ্পল ছিল পছন্দের। ধর্মীয় কাজে নিষ্ঠাবান ছিলেন। দরিদ্রদের নিয়মিত দানখয়রাত করতেন। রমযানে দই-চিড়ায় মুসলমানদের ইফতার করাতেন। যৌবনে শিকার পছন্দ করতেন। পড়ন্ত বেলায় ছিলেন নিরামিষভোজি। স্বল্পাহারি। হেমচন্দ্র দীর্ঘ দিন কাশি বাস করে হেমনগরে চলে আসেন। খুব সম্ভব ১৯২৫ সালে এখানেই দেহত্যাগ করেন।’
গনেশ রক্ষিত আরো জানান,‘ দুর্গা পুঁজা ছাড়াও কার্তিক মাসের আমাবস্যা তিথিতে হাজারো দ্বীপ জ্বালিয়ে (দ্বীপাবলী) বর্ণাঢ্য কালী পুজা হতো। ফাল্গুনে দোলপূর্ণিমায় হুলিখেলায় হেমনগর জেগে উঠতো। হেমচন্দ্র বেঁচে থাকতেই নায়েব কাচারিতে সহকারি নায়েব হিসাবে চাকরি পান। একটানা বিশ বছর জমিদার স্টেটে চাকরি করেন। বিজয় কুমার ভট্রাচার্য, রাসবিহারি ধর এবং রামমোহন গাঙ্গুলির মত অভিজ্ঞ নায়েব বাবুর অধীনে কাজ করেছেন। ২৫ টাকা বেতনে চাকরি শুরু। শেষ হয় ৩৫ টাকায়। তখন ৮ পয়সায় এক সের কেরোসিন পাওয়া যেতো। পাট ছিল দুই থেকে তিন টাকা মন।’ দুই আনায় লুঙ্গি এবং চার আনায় ধুতি পাওয়া যেতো।
তিনি কয়েকজন সহকর্মীর উদ্ধৃতি দিয়ে আরো জানান,‘ হেমনগর জমিদারের তদবিরে পিংনায় মুন্সেফ র্কোট, পোস্ট অফিস ও টেলিগ্রাম অফিস চালু হয়। একই সাথে হেমনগর ডাকঘর ও টেলিগ্রাম অফিস চালু হয়। রাজধানী কোলকাতাসহ সারা ভারতে যোগাযোগ হতো এ দুটো টেলিগ্রাম অফিসের মাধ্যমে। হেমচন্দ্র স্বর্গীয় লাভের পর চার পুত্র হেরম্ভ চৌধুরী, গঙ্গেস চৌধুরী, প্রফুল্ল চৌধুরী এবং যোগেশ চন্দ্র চৌধুরীর মধ্যে স্টেট ভাগ হয়ে যায়। হেমচন্দ্রের চার মেয়ে ছিল। এরা হলেন সুরবালা দেবী, কিরনবালা দেবী, সুশীলাবালা দেবী এবং সুনীতিবালা দেবী। হেমচন্দ্রের বোন ছিল তিন জন। এরা হলেন স্বর্ণময়ী দেবী, বরোদা সুন্দরী দেবী এবং ক্ষিরোদা সুন্দরী দেবী। স্বর্ণময়ী দেবীর স্বামীর নাম নীলকান্ত গাঙ্গুলী। নীলকান্তের পুত্র হলেন শ্যামাকান্দ গাঙ্গুলী ও সূর্যকান্ত গাঙ্গুলী। সূর্যকান্ত গাঙ্গুলী দীর্ঘ দিন হেমনগর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
শ্যামাকান্ত গাঙ্গুলীর পুত্র ছিলেন কেদারনাথ গাঙ্গুলী। আর কেদারনাথ গাঙ্গুলীর পুত্র হলেন কমলনাথ গাঙ্গুলী। ৪৭ এ দেশভাগের আগে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটলে হেমচন্দ্রের উত্তরাধিকারিরা ফাল্গুন মাসের এক রাতে জগন্নাথগঞ্জঘাট হয়ে ট্রেনে কোলকাতা পাড়ি জমান। নগদ টাকা আর স্বর্ণলঙ্কার ছাড়া স্থায়ী-অস্থায়ী সবকিছু রেখে যান। সাজানোগোছানো রাজবাড়ি, হাতিঘোড়া, চিড়িয়াখানার পশুপাখিসহ সবই অক্ষত রেখে যান। হয়তো তারা ভেবেছিলেন সময় পার হলে সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে আবার ফিরে আসবেন। হেরম্ভ চৌধুরী মনের ভুলে ১৬শ ভরি স্বর্নে মোড়ানো একটি রাজকীয় চেয়ার রেখে যান। ৪৭ এর এপ্রিল মাসে ময়মনসিংহ থেকে ইংরেজ সহকারি কালেক্টর জনস্টুয়ার্ড পুলিশ নিয়ে এসে রাজবাড়ি থেকে ওই রাজকীয় চেয়ার উদ্ধার করে নিয়ে যান। জুলাই মাসে সেটি হেরম্ভ চৌধুরীর পুত্র নিতাই চৌধুরীর নিকট হস্তান্তর করেন।
আগস্ট মাসে পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে হেমচন্দ্রের উত্তরাধিকাররা আর ফিরে আসেননি। আগস্ট মাসের শেষ একদল লাঠিয়াল। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজবাড়ির মূল্যবান আসবাব ও তৈজসপত্র লুট হয়। চিড়িয়াখানা ও নাটমহলের সব কিছু তছনচ হয়ে যায়। তিনচার মাসের ব্যবধানে রাজবাড়ি প্রেতপুরিতে পরিণত হয়।
গণেশ রক্ষিত জানান, তিনি বাল্যে কোলকাতা থেকে আসা আত্মীয়স্বজনের নিকট থেকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের গল্প শুনেছেন। যৌবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জগন্নাথগঞ্জঘাট দিয়ে স্টিমারে ও ট্রেনে ব্রিটিশ সৈন্য পারাপার হতে দেখেছেন। সাতচল্লিশে দেশভাগ দেখেছেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। তার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের ঘটনা হলো জমিদার আমলের অনেক দলিলদস্তাবেজ বাড়িঘর থেকে লুট হয়ে যাওয়া। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর অত্যাচারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গেলে দুবৃর্ত্তরা তার বাড়ি থেকে অনেক দুস্প্রাপ্য কাগজ পত্র লুট করে নিয়ে যায়।
শতাব্দী বছর পেরিয়ে এখনো তিনি সুস্থ জীবনযাপন করছেন। চশমা ছাড়াই পত্রিকা পড়েন। ভোরে আধা ঘন্টা মর্নিং ওয়াক করেন। সকালে চিড়ামুড়ি ও কলায় নাস্তা এবং দুপুরে ও রাতে ভাত খান। কখনোই মাংস খাননা। এক বেলা মাছ ও দুধ খান। খাবারের বড় অংশ জুড়ে থাকে সবজি। বাড়ির পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় পাতা বাঁশের মাচানে নাতিপুতি ও গ্রামের শিশুকিশোরদের নিয়ে গল্প করে সময় কাটান তিনি। বই ও পত্রিকা পড়া তার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। স্ত্রী আশালতার বয়স ৯০ বছর। এখনো চলাফেরা করতে পারেন। সুখি দম্পতি তারা। চার পুত্র ও এক কণ্যার জনক গণেশ দম্পতি। বড় পুত্র মনিন্দ্র রক্ষিত ৭০ ছুঁই ছুই। অপর তিন জন হিরেন্দ্র, কালিদাস ও অজয় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ছয় নাতিপুতি নিয়ে সুখের সংসার গণেশ রক্ষিতের। দীর্ঘায়ু লাভের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ত্রিকালদর্শী এ প্রবীণ জানান, জীবনে কারো সাথে প্রতারণা করিনি। মিথ্যা বলার চেষ্টা করিনি। মানুষকে কষ্ট দেয়নি। যা আছে তাই নিয়ে নিজেকে সুখি ভেবেছি। ধর্মের অনুশাসণ মেনে চললে মানুষ উদার হতে শেখে। আর উদার মানুষ মহৎ ও সুখি হয়। দীর্ঘায়ু জীবন লাভের জন্য এটাই সর্বোৎকৃষ্ঠ পথ।
প্রবন্ধকার :
গোপালপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি, দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদদাতা এবং মধুপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩