‘নাইয়া বড়ই ভাগ্যবান, সোনার মেডেল পাইলো দান’
-জয়নাল আবেদীন
নৌকার বহুমাত্রিক ব্যবহার বাঙ্গালীর চিরায়ত। জালের মত ছড়িয়ে থাকা নদ-নদী-খাল-বিল গাঙ্গেয় উপদ্বীপের বৈশিষ্ট্য। সুপ্রাচীনকাল থেকে এ জনপদের বাসিন্দাদের জীবনজীবিকা ও সংস্কৃতির সাথে জুড়ে রয়েছে বান-বণ্যা, নাবী-নৌকা, নৌবাহিক ও নৌযাত্রা। মহাকবি কালিদাস রঘুবংশ মহাকাব্যে বঙ্গবাসিদের ‘নৌসাধন্যেদ্যতান’ উপাধি দিয়েছেন। ‘চন্ডিমঙ্গল’ কাব্যে কবি মুকুন্দ রাম বঙ্গে তিনশ গজ লম্বা নৌকার উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন চর্যাপদের চাটিল্লপাদের চর্যাতে নৌগীতি, নৌবাট, নৌসারি, নৌজীবিকা, নৌডাকাতি ও নৌদুঘর্টনার উল্লেখ হয়েছে। বৌদ্ব চর্যা গীতিকারগণ দেবতার সন্তষ্টি অর্জন অথবা হৃদয়ের শূণ্যতা নিবারণে গুণ টানা, হাল ও বৈঠা চালকদের মুখে সারি গানের ছত্র তুলে ধরেছেন। চর্যাপদের বিপরীত যুগে ‘বল্লাল চরিত’ এ সেন বংশের রাজা লক্ষন সেনকে বায়াত্তর দাড়ের নৌকায় বিহারের তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। বখতিয়ার খলজির তাড়া খেয়ে ১২০৪ সালে রাজা লক্ষন সেন রাজধানী নদীয়া ছেড়ে ময়ূর পঙ্খী নায়ে বিক্রমপুরে পালিয়ে আসেন। প্রাচীন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে কর্মচাঞ্চল্যেও নেপথ্যে ছিল নদী ও নৌকা। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন, হিউয়েন সাঙ ও ইৎসিয়েং এর বিবরণ এবং দন্ডী রচিত দশ কুমার চরিত থেকে বাংলা জনপদের বণিকদের সপ্তডিঙা সাজিয়ে দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার ঘাটে ঘাটে বাণিজ্য করার তথ্য রয়েছে। ওইসব পর্যটকরা নৌকা বিহারের সময় জলপথের মাঝিমাল্লাদের মুখে সুর তুলে গান গাওয়ার কথা বলেছেন। ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের শাসনামলে মরক্কোর মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয় আসেন। সিলেট থেকে নদীপথে সোনারগাঁ আসার সময় নৌকারোহীদের ঢোল বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করার তথ্য দিয়েছেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রেহালায়। নবাবী আমলে বাংলায় মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের উপদ্রব শুরু হয়। ওরা দ্রুতগামী নৌকায় বাংলার নিন্মাঞ্চলে বর্ষাকালে ডাকাতি করে ফিরতো। লুট ছাড়াও বঙ্গবাসিকে বন্দী করে দাস হিসাবে বিদেশে বিক্রি করে দিত। মগ-ফিরিঙ্গিরা বার্মা থেকে আনা সেগুন কাঠে নির্মিত ছিপ নৌকায় জলদস্যুতা করতো। ছিপ ছিল দ্রুতগামী নৌকা। নবাবী যুগে রচিত একাধিক ঐতিহাসিক গ্রন্থে বাংলার নবাবরা মগফিরিঙ্গিদের অত্যাচার বন্ধে স্থানীয় কারিগর দিয়ে দ্রুতগামি কোশা, ছিপ ও আরঙ্গি নৌকা নির্মাণ করেন। এসব নৌকায় করে পাহারা বসিয়ে জলদস্যুদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা চলে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রকাশিত বুলেটিন থেকে জানা যায়, বাঙ্গালী স্বভাবজাতভাবে নৌপ্রেমিক। ব্রিটিশ আমলে এদেশে নৌকা রেস এর প্রকৃত প্রচলন শুরু। জমিদাররা চলনবিলসহ দেশের বড় বড় নদীতে নৌডাকাতি বন্ধে নৌপাহারার ব্যবস্থা করেন। বিষয়টিকে উৎসবমুখর করার জন্য নৌকাবাইচের প্রচলন করা হয়। নাটোরের জমিদার রাণীভবানী, হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী, মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত রায়, ধনবাড়ির জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী, আমবাড়িয়ার জমিদার কালিপ্রসন্ন্ সিংহ, দিঘপাইতের জমিদার, সন্তোষের জমিদারসহ প্রভাবশালী ভূস্বামীরা বর্ষা মৌসুমে নৌকাবাইচের আয়োজন করতো। গোপালপুর উপজেলার ঝিনাই নদীর ঝাওয়াইল ঘাটে হতো সবচেয়ে বড় নৌকাবাইচ। আশপাশের ধনবাড়ি, সরিষাবাড়ি, ঘাটাইল, মধুপুর ও ভূয়াপুর উপজেলার প্রতিযোগিরা নৌকাবাইচে অংশ নিতো। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারের তথ্যে দেখা যায়, ১৯৪০ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহে নৌকাবাইচ নিয়ে জমিদারের লাঠিয়ালরা জড়িয়ে পড়ায় তিনটি পৃথক সংঘর্ষে ৬ জন প্রাণ হারায়। ১৯৪১ সালে গোপালপুর উপজেলার ভেঙ্গুলা ও ঝাওয়াইল মৌজায় ঝিনাই নদীতে নৌকাবাইচ নিয়ে হেমনগর ও ধনবাড়ি জমিদারের প্রজারা সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ঝাওয়াইল বাজারে তখন রাণীভবানীর কাচারি ছিল। ঝাওয়াইল ইউনিয়নের মধাংশ ছিল রাণীভবানীর, দক্ষিন অংশ হেমনগর এবং উত্তর ধনবাড়ি জমিদারের তালুক। রানীভবানীর প্রজারা ধনবাড়ি প্রজাদের সাথে যোগ দিলে হেমনগর জমিদারের নায়েব ও বরকন্দাজরা পিটুনির শিকার হয়। ওই নায়েবের মাথা মুড়িয়ে দেয়া হয়। হেমনগর জমিদার এটিকে প্রেস্টিজ ইস্যু ধরেন। কোলকাতা আদালতে মামলা করেন। ধনবাড়ি জমিদার প্রজাদের পক্ষ নিয়ে মামলায় লড়েন। সাক্ষির অভাবে তিন বছর পর মামলা ডিসমিশ হয়ে যায়।
নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে গোপালপুর পৌরসভার ডুবাইল গ্রামে ১৯৮২ সালে এক সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে গোপালপুরের ঝিনাই ও বৈরান তীরবর্তী গ্রাম নৌকা উৎসব মেতে উঠে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করে নৌকা ভ্রমণ ও নৌকা বাইচের। নৌকাবাইচের তীর্থভূমি ঝাওয়াইল এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার প্রতিবছর বর্ণাঢ্য নৌকা বাইচের আয়োজন করেন। ঝাওয়াইলের ঝিনাই নদীতে দুদিনব্যাপি নৌকাবাইচ গত শুক্রবার শেষ হয়। নদীর উভয় পাড়ের তিনচার কিলো জুড়ে ভিড় জমায় হাজারো দর্শক। পরে বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন ইউনুস ইসলাম তালুকদার। জনতা ব্যাংকের সিবিএ নেতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম চ্যাম্পিয়ন দলকে দুই ভরি ওজনের নৌকার মেডেল পুরস্কার দেন। অন্যাণ্য বিজয়ীরা পান ফ্রিজ ও রঙ্গিন টেলিভিশন। বিজয়ীরা পুরনো দিনের সারি গান ‘নাইয়া বড়ই ভাগ্যবান সোনার মেডেল পাইলো দান’ সুর তুলে নেচে গেয়ে উচ্ছাস করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান প্রত্যেক অংশগ্রহনকারি নৌকাকে তিন হাজার টাকা, দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া নৌকাকে ৫ হাজার টাকা এবং তিন শতাধিক অংশগ্রহনকারিকে জার্সি উপহার দেন। ডুবাইল ও দিঘলআটা গ্রামে ইতিমধে দুই দফা নৌকাবাইচ হয়েছে। আরো কয়েক স্থানে নৌকাবাইচের আয়োজন চলছে। পূর্বাকাশকে তিনি জানান, বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। মানুষ দুবেলা খাওয়াপরার নিশ্চয়তা পাওয়ায় এখন বিশুদ্ধ বিনোদন খুঁজছে। নৌকাবাইচ একটি নির্মল বিনোদন। নৌকা দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। নৌকা বাইচের মাধ্যমে দলীয় প্রতীক নৌকাকে আরো জনপ্রিয় করা হচ্ছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহি এ সাংস্কৃতিক ধারাকে রাজনৈতিক বলয়ে সামিল করে সামনে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩