-জয়নাল আবেদীন
ব্রিটিশ আমল থেকেই গোপালপুর শিক্ষাদীক্ষায় ছিল অগ্রসর জনপদ। ১৯০০ সালে হেমনগর শশীমূখি উচ্চবিদ্যালয়, ১৯০২ সালে রাধারাণী গার্লস হাইস্কুল, ১৯২০ সালে সূতিভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুল, ১৯২৮ সালে ঝাওয়াইল হেমন্তকুমারী হাইস্কুল এবং ১৯৩৯ সালে ঝাওয়াইল রাজকুমারী সুরেন্দ্রবালা গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদীক্ষার এ সত্যতা বুঝা যায়। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারের তথ্য মোতাবেক, ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত জরীপে দেখানো হয়, টাঙ্গাইল মহকুমা শহর বাদে (সে সময়ে টাঙ্গাইল ছিল ময়মনসিংহ জেলার আওতায় একটি মহকুমা) শিক্ষার হার ও ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল গোপালপুর উপজেলায়। ঝাওয়াইলের কাহেতা, অর্জুনা (বর্তমানে ভূয়াপুর উপজেলায় পড়েছে) ও সমেশপুর ছিল জেলার অন্যতম শিক্ষিত ও সজ্জন মানুষের গ্রাম। শিক্ষাদীক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও গোপালপুর ছিল মশহুর। হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরি মুসলিম বিদ্বেষী হলেও ফুটবলের সমঝদার ছিলেন। সে সময় রাজধানী কোলকাতার জন্য পূর্ববাংলার যোগাযোগে ছিল পশ্চিমমুখো। সিরাজগঞ্জের মাধ্যমে গোপালপুরের সোনালী আশঁ পাটের চালান যেত কোলকাতায়। এজন্য উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ঝাওয়াইল ইউনিয়নের যমুনা তীরবর্তী সুবর্ণ গ্রামে (বর্তমানে সোনামুই) গড়ে উঠে নৌবন্দর। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ হয়ে স্টিমার যেত আসাম। এ স্টিমার থামতো সুবর্ণ গ্রামে। এখান থেকে সরাসরি কোলকাতা যাওয়া যেত লঞ্চে। অতসব সুবিধার জন্যই মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়ার জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী উনবিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকে সুবর্ণগ্রামেই গড়ে তোলেন রাজবাড়ি। প্রাসাদের পূর্ব দিকে ছিল বিরাট খেলার মাঠ। দুর্গাপূজার সময় মাঠে বসতো মেলা। আর ফুটবল মৌসুমে প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো। ফাইনাল খেলায় কোলকাতা থেকে আসতো নামকরা ফুটবলাররা। ১৯০৫ সালে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হয়ে ঢাকা-কোলকাতা রেলসার্ভিস চালু হওয়ায় কোলকাতার ফুটবল উত্তাপ সুবর্ণ গ্রাম পর্যন্ত ছড়াতো। পরবর্তীতে যমুনার ব্যাপক ভাঙ্গনের দরুন সুবর্ণ গ্রামের নদীবন্দর ও রাজবাড়ি নদীগর্ভে বিলীণহলেও ইতিহাস থেমে যায়নি। হেমচন্দ্র চৌধুরী শিমলাপাড়া মৌজায় নতুন করে নির্মান করেন পরী দালান নামে খ্যাত রাজবাড়ি। সে যাই হোক, সুবর্ণ বন্দর বিলুপ্তির পর হেমচন্দ্র চৌধুরীর সহযোগিতায় নলিন নদীবন্দর গতি লাভ করে। আর নলিন বাজারের পাশে গড়ে উঠে একটি খেলার মাঠ। এ মাঠের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। এ মাঠেই খেলে গেছেন কোলকাতার মোহন বাগানের সেরা ফুটবলার অসীম ধর ও নন্দ সেন। (সূত্র কোলকাতার দৈনিক আনন্দ বাজার) রাজশাহীর পুটিয়ার জমিদারের নায়েব কাঁচারি ছিল ঝাওয়াইল বাজারে। গোপালপুর উপজেলা তখন পুখুরিয়া পরগনার অংশ হিসাবে (ভূয়াপুর উপজেলা তখন গোপালপুর উপজেলার অংশ ছিল) নাটোরের জমিদার মহারাণী হেমন্তকুমারী, হেমনগরের জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী এবং ধনবাড়ির জমিদার নবাবজাদা সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর রাজত্ব ছিল। রাণী হেমন্ত কুমারী পাঁচ একর সম্পত্তি দান করে তিনি ঝাওয়াইলে নিজ নামে এবং একমাত্র কণ্যা রাজকুমারী সুরেন্দ্র বালার নামে দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তিনি ঝাওয়াইল কাঁচারি পাড়ার সাথে একটি বড় খেলার মাঠও নির্মাণ করে যান। প্রায় একশ বছর ধরে ঝাওয়াইলের এ মাঠ শত শত খেলোয়াড়কে তৈরি করেছে। পাকিস্তানের শেষ দশক পর্যন্ত ইন্টার স্কুলের ফুটবল প্রতিযোগিতায় সূতি ভিএম হাইস্কুল আর ঝাওয়াইল মহারাণী হেমন্তকুমারী হাইস্কুলের মধ্যেকার প্রত্যেকটা খেলা হতো প্রবল প্রতিদ্বন্ধিতা ও উত্তেজনাপূর্ণ। গোলযোগ হতো কোনো কোনো বছর। ঝাওয়াইল কখনোই সূতি ভিএমকে ছেড়ে কথা বলতোনা। কিন্তু নানা কারণে ঝাওয়াইল আজ পিছিয়ে গেছে। আর সূতি ভিএম দেশ জুড়ে সুনাম কুড়িয়ে সবার মুখ উজ্জল করছে। বর্তমান প্রজন্ম গোপালপুর উপজেলার বিখ্যাত প্রফুল্লনগরের নাম জানেনা। অথচ ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানের শেষ দশক পর্যন্ত সৈয়দপুর বাজার তথা প্রফুল্ল নগর মাঠে প্রতিবছর জমজমাট ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হতো। সৈয়দপুর নায়েব কাচারি তথা ভূমি অফিসের পাশে এখনো প্রফুল্লনগর খেলার মাঠটির অস্তিত্ব রয়েছে। হেমনগর জমিদার এ মাঠের জন্য দুই একর জমি দিয়ে যান। কিন্তু কালক্রমে খাস খতিয়ান দেখিয়ে তা জবরদখল হয়ে গেছে। একইভাবে ধনবাড়ির জমিদাররা পানকাতা হাইস্কুলের খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। মে জুন এলে গোপালপুর উপজেলার উল্লেখিত খেলার মাঠ জমজমাট হয়ে উঠতো ফুটবলে। কিন্তু কালক্রমে রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য প্রবেশ করায় আশির দশক থেকে গোপালপুরের ফুটবল অঙ্গণ ঝিমিয়ে পড়ে। খেলার মাঠ ছেড়ে তরুণ ও যুবকরা মাদক আর সন্ত্রাসে দীক্ষা নেয়। খেলাধূলার শত বছরের ঐতিহ্য গোপালপুর হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু সূতি ভিএম স্কুল গোপালপুর বাসিকে এধরনের হতাশা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন এ বিদ্যালয়টি শুধু লেখাপড়ায় নহে, ক্রিড়া জগতেও অপ্রতিদ্বন্ধি। গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের গ্রীস্মকালিন স্কুলমাদ্রাসা ফুটবল প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত খেলায় আমিনুল ইসলাম রুবেলের হ্যাটট্রিকে ৫-০ গোলে কুমিল্লার বিবির বাজার পাইলট হাইস্কুলকে পরাজিত করে তৃতীয় বারের মত চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মাঠে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সূতি ভএম হাইস্কুলের কৃতি খেলোয়াড়দের প্রশংসা করেন এবং পুরস্কার তুলে দেন। ২০০৬ সালে ফুটবলে জাতীয় পর্যায়ে ৩য়, ২০০৭ ও ২০০৯ সালে চ্যাম্পিয়ন, ২০১১সালে রানার্স আপ হয়। ছেলেদের পাশাপাশি এ স্কুলের মেয়েরাও জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় ২০১১, ২০১২, ২০১৩ সালে টানা তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে হেটট্রিক করে। এ স্কুলের ছাত্র শাকিল হোসেন ২০০৫ সালে কেরাম প্রতিযোগিতায় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। মেয়ে ক্রিকটাররা প্রতিবছরই জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে।
লেখক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদিন, দৈনিক ইত্তেফাকের গোপালপুর সংবাদদাতা এবং গোপালপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি।
সম্পাদক : অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন | নির্বাহী সম্পাদক : কে এম মিঠু
প্রকাশক কার্যালয় : বেবি ল্যান্ড, বাজার রোড গোপালপুর, টাঙ্গাইল -১৯৯০, বাংলাদেশ।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত - ২০১৯-২০২৩